সত্তর দশকে ডাচ ফুটবলে ইয়োহান ক্রুইফই ছিলেন শেষ কথা। সেই ‘শেষ কথা’ এর আগে যিনি ছিলেন, তাঁকে খুব বেশি মানুষ ক্রুইফের মতো করে মনে রাখেনি। ঠিক যেভাবে প্রথমকেই সবাই মনে রাখেন, দ্বিতীয় ব্যক্তিকে না।
ডাচ ফুটবলের সেই সময়ে ইয়োহান নিসকেন্স ছিলেন সেই ‘দ্বিতীয়’ ব্যক্তি—বার্সেলোনার সমর্থকেরা যাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘ইয়োহান দ্য সেকেন্ড’ (দ্বিতীয় ইয়োহান)। অর্থাৎ, ক্রুইফ হলেন প্রথম ইয়োহান, নিসকেন্স দ্বিতীয়। নিসকেন্স নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার হতে আমার আপত্তি নেই।’
ক্রুইফকে প্রথম সেরা হিসেবে ধরেই এই মন্তব্যটি করেছিলেন নিসকেন্স। আরেকটি বিচারেও নেসকেন্সের আগেই রইলেন ক্রুইফ। ‘টোটাল ফুটবল’ এর প্রতিভূ মারা গেছেন ৮ বছর আগে। আর নিসকেন্স তাঁর কাছে পাড়ি জমালেন আজ। ডাচ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আজ তাঁর ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুর খবর জানিয়েছে।
রাইনাস মিশেলের অধীনে আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডস দলে ‘টোটাল ফুটবল’ খেলে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রুইফ, নিসকেন্স, আরি হাঁন, রুদ ক্রল ও জনি রেপদের প্রজন্ম। নেসকেন্স সেই প্রজন্মের অন্যতম সেরা হিসেবে ’৭৪ ও ’৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলেছিলেন ডাচদের হয়ে। বাকিটা আপনি জানেন। ডাচদের সেই টানা দুই ফাইনাল হারের ‘কমলা দুঃখ’ আজও যায়নি। যে মানুষটি আয়াক্সে ক্রুইফের সঙ্গে টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছেন, ডাচদের ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ জাতীয় দলের অন্যতম প্রাণভোমরা ছিলেন—সেই নিসকেন্সকে পৃথিবীর মায়া কাটাতে হলো জাতীয় দলের হাতে বিশ্বকাপ না দেখেই।
নিসকেন্স ঠিক কী কারণে মারা গেছেন, ডাচ ফুটবল ফেডারেশন (কেনভিবি) তা জানাতে পারেনি। রোববার তিনি মারা যাওয়ার পর আজ কেনভিবির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইয়োহান নিসকেন্সের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ডাচ ও আন্তর্জাতিক ফুটবল একজন কিংবদন্তিকে হারাল।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ট্যাকল, অন্তর্দৃষ্টি ও আইকনিক পেনাল্টিগুলোর জন্য ডাচ ফুটবলের অন্যতম শীর্ষ খেলোয়াড় হিসেবে চিরকাল তাকে মনে রাখা হবে।’
সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে বিবেচিত নিসেকন্সকে নিয়ে তাঁর সাবেক আয়াক্স সতীর্থ সিয়াক সোয়ার্ট একবার ফিফাকে বলেছিলেন, ‘মিডফিল্ডে সে দুজনের সমান।’ আসলে মাঝ মাঠে নিসকেন্স যেমন শক্তিশালী তেমনি মসৃণ খেলোয়াড় ছিলেন। ক্লান্তিহীন দৌড়াতে পারতেন। ডিফেন্ডার ও ফরোয়ার্ড হিসেবেও খেলতে পারতেন—টোটাল ফুটবল ছকে তখনকার ডাচ দলে বেশির ভাগ ফুটবলারের যেমন বৈশিষ্ট্য ছিল আর কী!
উয়েফার ওয়েবসাইটে তাঁর খেলা নিয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘ইস্পাতদৃঢ় মিডফিল্ডার, অক্লান্ত দৌড়বিদ, কিন্তু দারুণ টেকনিক এবং গোল করতেন। মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন ক্রুইফের জ্বলে ওঠার। অবিশ্বাস্য স্ট্যামিনা, বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার, শক্তিশালী শটও নিতেন। আর প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে বল পুনরুদ্ধার করতেন।’
১৯৭৪ বিশ্বকাপে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ গোল করেছিলেন নিসকেন্স। ১৯৫১ সালে আমস্টারডামের হিমস্টাডে তাঁর জন্ম। ১৯৬৮ সালে স্থানীয় রেসিং হিমস্টাডে খেলা শুরুর দুই বছর পর তাঁকে আয়াক্সে টানেন ‘টোটাল ফুটবল’ এর জনক রাইনাস মিশেল। ১৯৭১ সালে আয়াক্সের হয়ে ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের সময় রাইটব্যাক ছিলেন নিসকেন্স। পরের দুটি বছরে একই শিরোপা জেতেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে।
ক্রুইফ-মিশেলের সঙ্গ ধরে রাখতে ১৯৭৪ সালে বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছিলেন নিসকেন্স। পাঁচ বছরেই বার্সা সমর্থকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই খেলোয়াড় ক্লাবটির হয়ে কোপা দেল রে ও ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ জিতেছেন। ১৯৭৯ সালে বার্সা ছেড়ে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসে। সেখানে পাঁচ মৌসুম খেলার পর কিছুদিনের জন্য ডাচ ফুটবলে ফিরে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান নিসকেন্স। ১৯৯১ সালে অবসর নেওয়ার আগে খেলেছেন সুইস ক্লাব সুকে। নেদারল্যান্ডসের হয়ে ৪৯ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ১৭। খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়েও নেমেছিলেন নিসকেন্স। ডাচ জাতীয় দল, বার্সা, গ্যালাতাসারাই ও অস্ট্রেলিয়ার সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
নিসকেন্সের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে নেদারল্যান্ডস জাতীয় দল হাঙ্গেরি ও জার্মানির বিপক্ষে তাদের আগামী দুটি প্রীতি ম্যাচে এক মিনিট নীরবতা পালন করবে। ডাচ জাতীয় দলের বর্তমান কোচ রোনাল্ড কোম্যানের চোখে নিসকেন্স তাঁর ‘সবচেয়ে বড় আদর্শ।’ শৈশবে রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল খেলার স্মৃতিচারণা করে কোম্যান জানিয়েছেন, তাঁর বন্ধুরা হয় ক্রুইফ নয় নিসকেন্স হতে চাইতেন। ‘কিন্তু আমি নিসকেন্স হতে চাইতাম’—স্থানীয় বার্তা সংস্থা এএনপিকে বলেছেন কোম্যান।
নিসকেন্সের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে আয়াক্স, ‘ইয়োহান নিসকেন্সের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা রইল। শান্তিতে ঘুমাও, আয়াক্স কিংবদন্তি।’
হ্যাঁ, মাঠের জুটির মতো অন্যলোকেও নিসকেন্স এখন ক্রুইফের সঙ্গে শান্তিতে ঘুমোবেন।