কমলা হ্যারিসের জয়ের অনিশ্চয়তা বাড়ছে

কাগজে-কলমে দেশজুড়ে কমলা হ্যারিস রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় কমবেশি ২ পয়েন্টে এগিয়ে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত সাতটি ‘ব্যাটল গ্রাউন্ড’ অঙ্গরাজ্যের চারটিতে খুব সামান্য ব্যবধানে হলেও এগিয়ে কমলা। তারপরও নভেম্বরের নির্বাচনে তাঁর বিজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ যাচ্ছে না।

এ কথা বলার প্রধান কারণ, নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের প্রবেশের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে যে প্রবল আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিল, তা এখন কার্যত এক জায়গায় এসে ঠেকে রয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কমলার পক্ষে অতিরিক্ত সমর্থন আদায়ের জায়গা হয়তো আর নেই বা থাকলেও অতি সামান্য। বর্তমানে জনমত জরিপের এ ফলাফল মার্জিন অব এরর বা ত্রুটির সীমার ভেতর। অর্থাৎ এই জরিপ সত্য হলে কমলা জিততেও পারেন, আবার পরাস্ত হতেও পারেন। আগামী ৫ নভেম্বর হবে সেই পরীক্ষা।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এ প্রকাশিত গত শুক্রবারের জরিপ অনুসারে জাতীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোয় কমলার অবস্থা কার্যত অপরিবর্তিত। বিজয় নিশ্চিত করতে তাঁকে নিদেনপক্ষে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিনে কমবেশি যেমন ব্যবধানেই হোক, জিততে হবে। সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগছে।

উদাহরণ হিসেবে মিশিগানের কথা ভাবা যাক। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর শুক্রবারের জরিপে এই অঙ্গরাজ্যে কমলা ৪৭: ৪৫ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। গত আগস্ট থেকে এ অবস্থা কার্যত অপরিবর্তিত।

কিন্তু এর সঙ্গে যদি গ্রিন পার্টির জিল স্টাইনকে যুক্ত করি, তাহলে ফলাফল বদলে যেতে পারে।

মিশিগানে কমলার জন্য বড় বিপদ মুসলিম ও আরব ভোট নিয়ে। এখানে প্রায় তিন লাখ আরব ও মুসলিম নাগরিকের বাস, যাঁদের দুই লাখ তালিকাভুক্ত ভোটার। এক বছর ধরে গাজায় এবং এখন লেবাননে ইসরায়েলি হামলার মুখে তাঁদের অনেকেই ডেমোক্র্যাটদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই ইসরায়েল এমন নির্বিচার গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। এ অঙ্গরাজ্যের মুসলিমদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তিনি এমন একজন আরব বা মুসলিমকেও জানেন না যে কমলাকে ভোট দেবেন। তাঁরা হয় ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, নয়তো ভোটদানে বিরত থাকবেন।

শুধু আরব-মুসলিম ভোটার নন, এই অঙ্গরাজ্যের প্রগতিশীল ভোটাররাও ইসরায়েল প্রশ্নে বাইডেন-কমলা প্রশাসনের ইসরায়েল-তোষণ নীতিতে অসন্তুষ্ট। তাঁদের অনেকেই প্রতিবাদ হিসেবে গ্রিন পার্টির জিল স্টাইনকে ভোট দিতে পারেন। ২০২০ সালে বাইডেন বেশি ব্যবধানে মিশিগান জিতেছিলেন, কিন্তু এবার কমলা-ট্রাম্পের ভোটের ব্যবধান কয়েক হাজারের বেশি হবে না বলে ভাবা হচ্ছে। ২০১৬ সালে গ্রিন পার্টির পক্ষে জিল স্টাইন এখানে পেয়েছিলেন ৫১ হাজার ভোট। এবারে সেই একই ঘটনা ঘটলে কমলার জন্য দুঃসংবাদ হবে। মনে করা যেতে পারে, ২০১৬ সালে আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য উইসকনসিনে জিল স্টাইনের বাক্সে পড়া ৩১ হাজার ভোটের কারণেই হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের কাছে হেরেছিলেন। সেখানে তাঁর ও ট্রাম্পের ভোটের ব্যবধান ছিল ২১ হাজার ভোট।

উদ্বেগ পেনসিলভানিয়া নিয়েও। সেখানে দুই বা তার চেয়েও বেশি পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন কমলা। কিন্তু এই নতুন জরিপে তিনি ১ পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েছেন (৪৬: ৪৫)। নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা থেকে স্পষ্ট হয়, ট্রাম্প কেন বা কীভাবে এই অঙ্গরাজ্যে কমলাকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। এখানে আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্পের তুলনায় তিনি পিছিয়ে। কলেজ ডিগ্রি নেই এমন শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যেও ট্রাম্প এগিয়ে। এ কথা ঠিক নারী ভোটারদের মধ্যে কমলার সমর্থন বেশ, তিনি ১৩ শতাংশ ভোটে এগিয়ে, কিন্তু এই ব্যবধান পুরুষ ভোটারদের মধ্যে তাঁর সমর্থনের অভাব এড়াতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

সে কথা মাথায় রেখেই কমলার তরফ থেকে দুই দিন আগে পেনসিলভানিয়া এসেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি এখনো এ দেশে জনপ্রিয় রাজনীতিক। পিটসবার্গে এক নির্বাচনী ভাষণে ওবামা কার্যত সভায় উপস্থিত আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষদের কষে বলে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা কী করে আশা কর যে একজন বিলিয়নিয়ার মানুষ, যে নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে আগ্রহী নয়, সে তোমাদের স্বার্থ রক্ষা করবে?’

আরেক ব্যাটল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য অ্যারিজোনাতে কমলা অস্বস্তিতে আছেন সেখানকার হিস্পানিক পুরুষদের নিয়ে। তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ট্রাম্পের সমর্থক। গ্রুপ হিসেবে হিস্পানিকরা অধিক রক্ষণশীল, যাঁদের অনেকেরই কমলার তথা ডেমোক্র্যাটদের সমকামিতা ও লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন বিদ্বেষের সৃষ্টি করেছে। এখানে নিরঙ্কুশ সংখ্যার হিসাবে কমলা এগিয়ে (৫৯: ৩৫), কিন্তু এই অঙ্গরাজ্যের প্রায় ৩৫ শতাংশ হিস্পানিক ভোটার এখনো ঠিক করে ওঠেননি কাকে তাঁরা ভোট দেবেন। অভিবাসন সমস্যা ও অর্থনীতি প্রশ্নে তাঁদের অনেকেই কমলাকে নয়, ট্রাম্পকেই বেশি বিশ্বাস করেন। বস্তুত, শুধু পেনসিলভানিয়াতে নয়, সারা দেশেই এই দুই বিষয়ে কমলার তুলনায় ৯ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পের নেতৃত্ব অধিক আস্থাবান।

বাংলাদেশিরা যাঁরা এ দেশে ভোটার হিসাবে তালিকাভুক্ত, তাঁদের অনেকের মনোভাব অনেকটা হিস্পানিকদের মতোই। মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থানের কথা জেনেও তাঁরা ট্রাম্পের পক্ষে। তাঁদের অনেকে অব্যাহত অবৈধ অভিবাসনের বিরোধী, অনেকেরই মনোভাব খোলামেলাভাবে বর্ণবাদী বা রেসিস্ট। ডেমোক্র্যাটদের উদার নৈতিক সামাজিক নীতিকেও তাঁরা ঘৃণা করেন। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের সময় অর্থনীতি অনেক ভালো ছিল। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও মিশিগানের মতো ব্যাটল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যে, যেখানে সম্ভবত কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হবে, সেখানে বাংলাদেশি-আমেরিকানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

নির্বাচনের এখন মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি। এই শেষ সময়ে কমলাকে আরও একটা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লড়তে হচ্ছে, তা হলো তথ্য বিকৃতি ও সরাসরি মিথ্যাচার। ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই লজ্জার মাথা খেয়ে অনর্গল মিথ্যা বলেন। এবারও তার ব্যক্তিক্রম নয়। ওহাইয়োর স্প্রিংফিল্ডে গুজব উঠেছিল, সেখানে হাইতি থেকে আগত অভিবাসীরা তাঁদের প্রতিবেশীদের কুকুর-বেড়াল চুরি করে খেয়ে ফেলছেন। কথাটা মিথ্যা, শহরের কর্মকর্তারা সে কথা সবিস্তার জানিয়েছেন। ট্রাম্প তবুও সে কথা বলে বেড়াচ্ছেন। কারণ, মিথ্যা হলেও অভিবাসনবিরোধী মানুষদের কাছে এমন রগরগে কথা ভালো খায়।

আরেক বিপত্তি দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে। পরপর দুটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণের একাধিক অঙ্গরাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাম্প কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই বলে বেড়াচ্ছেন বাইডেন-কমলা প্রশাসন রিপাবলিকান প্রভাবাধীন এসব অঙ্গরাজ্যে ইচ্ছা করে ত্রাণ পাঠাচ্ছে না। এই দলের এক কংগ্রেস সদস্য এমন কথাও বলা শুরু করেছেন, ডেমোক্র্যাটরা জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা বেছে বেছে রিপাবলিকান–সমর্থিত অঙ্গরাজ্যে ঘূর্ণিঝড় পাঠাচ্ছে। পাগলের প্রলাপ, কিন্তু সেই প্রলাপে বিশ্বাস করে এমন লোকের অভাব নেই এ দেশে।