মিডিয়ার সংস্কার গোড়া থেকে প্রয়োজন: গোলটেবিলে বক্তারা

শুধু মিডিয়া আইনের পরিবর্তনই নয়, মিডিয়া পরিচালনার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে তারও মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। শনিবার (১২ অক্টোবর) এক গোলটেবিলে এমন মতামত দিয়েছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও সম্প্রচারমাধ্যমের পেশাজীবী ব্যক্তিরা।

‘মানুষের পক্ষে ব্রডকাস্ট মিডিয়া’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। বাংলাদেশ নেক্সট ঢাকার দৃকপাঠ ভবনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি যৌথভাবে আয়োজন করে পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট এবং ইনোভেশন সেন্টার ফর রিসোর্স ডাইভারসিটি (আইসিআরডি)। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন আইসিআরডি’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জীশান কিংশুক হক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলমের গবেষণাভিত্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে এই গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান করে দ্য মার্ভেল–বি ইউ এবং সি থ্রি সিক্সটি বাংলাদেশ।

এতে শিক্ষাবিদ, এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, প্রযোজক, বিজ্ঞাপনদাতা, সামাজিক মাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যম, ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্মসহ বাংলাদেশের সম্প্রচার ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়া খাতের উল্লেখযোগ্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেন। এ ছাড়া মিডিয়া যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় যেমন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সেন্সরশিপ ও আর্থিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে পাঠশালার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. শহিদুল আলম বলেন, মিডিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে এবং তা এখনও অব্যাহত। এটি পরিবর্তিত না হলে আমরা একে গণমাধ্যম বলতে পারি না।

চ্যানেল 24-এর নির্বাহী পরিচালক (ইডি) তালাত মামুন বলেন, আমাদের মিডিয়ায় স্বাধীন রাজস্ব উৎসের অভাব রয়েছে। সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলে না গেলে চ্যানেলগুলো কখনোই আত্মনির্ভরশীল হবে না।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো সরকার থেকে মিডিয়াকে বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। সংস্থাগুলো রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চ্যানেলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্প্রচার মাধ্যমের এই মিডিয়া-মাফিয়া সম্পর্ক শেষ করতে হবে।

গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার বলেন, চ্যানেলগুলোর সঠিক আয়ের একটি বড় অংশ মধ্যস্থতাকারীদের কাছে চলে যাচ্ছে। আমাদের এ বিষয়ে একটি কাঠামো প্রয়োজন। অনেক প্রভাবশালী টিভি মালিক পে-চ্যানেলের নিয়ম মানতে চান না।

গোলটেবিলে বিজ্ঞাপন সংস্থা ও সাংবাদিকতার মধ্যে দুর্নীতির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আশরাফ কায়সার বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা নিজ থেকেই ডিজিএফআই-এর কাছে রিপোর্ট করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী সাইমা ফেরদৌস জবাবদিহির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের ভাবতে হবে, মিডিয়া কার কাছে জবাবদিহি করবে। মালিকদের নৈতিক বিষয়ে কে প্রশিক্ষণ দেবে?

স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের সিওও মালিক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, সংস্থা ও টিভি চ্যানেলগুলো কোটার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। আমরা এখনো অনুমানের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি। কোনো স্পষ্ট দৃশ্যমানতা নেই।

এ সময় অংশগ্রহণকারীরা একাধিক টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) উৎসের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং এই শিল্পখাতে কর ফাঁকির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ড. সামিনা লুৎফা গণমাধ্যমের ‘মানবিক মূল্যবোধের’ ওপর গবেষণার মাধ্যমে স্বচ্ছতা আনার প্রস্তাব দেন।

দ্য ডেইলি স্টারের প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা তাজদীন হাসান বলেন, সম্পাদকদের তাদের মেরুদণ্ড শক্ত করতে হবে। মিডিয়ায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশ নেক্সট-এর সদস্য মুনাফ মোজিব চৌধুরী এবং প্রথম আলোর ডিজিটাল প্রধান এ বি এম জাবেদ সুলতান প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসায়িক মডেলে মিডিয়া মালিকানার বিনিয়োগের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেন।

এবারের গোলটেবিলের মূল আলোচনার একটি বিষয় ছিল মিডিয়া কনটেন্টের শক্তিমত্তা নিয়ে। জীশান কিংশুক হক বলেন, বর্তমান প্রজন্ম বিদ্যমান চ্যানেলগুলোতে মনোযোগ দিচ্ছে না। কারণ তারা মিডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করছে।

গোলটেবিলে স্পষ্ট বিজ্ঞাপন নীতিমালা, প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতার প্রসার এবং তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্যের প্রবেশাধিকারকে আরও স্বচ্ছ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ভয়েস ফর রিফর্মসের আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর; প্রথম আলোর প্রধান ডিজিটাল ব্যবসায়িক কর্মকর্তা এ বি এম জাবেদ সুলতান; বঙ্গ বিডির প্রধান কনটেন্ট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী হায়দার; পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল খ. ম. হারুন; এটিইসি অস্ট্রেলিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টর শুভাশীষ ভৌমিক; ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ফিল্ম ফেস্টিভালের উপদেষ্টা সৈয়দা সাদিয়া মেহজাবিন; পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এন রাশেদ চৌধুরী; সোমরা এমবিএল লিমিটেডের রিসার্চ ও ক্লায়েন্ট সার্ভিসেসের পরিচালক শাহরিয়ার নাসির খান; একসাথে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মুনাফ মোজিব চৌধুরী; হইচই বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সাকিব আর খান এবং দ্য মার্ভেল—বি ইউ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটি সাবরিন।