<

ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চুক্তি হচ্ছে না

পাকিস্তানে কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গ কোনো আলোচনা করার বা কোনো চুক্তিতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই দেশটির সেনাবাহিনীর। পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সামরিক সূত্র দ্য গার্ডিয়ানকে এ কথা জানিয়েছে। এর আগে ইমরান খান বলেছিলেন, তিনি কারাকক্ষ থেকেই সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হতে ইচ্ছুক।

বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী রয়েছেন ইমরান খান। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে গার্ডিয়ান–এর পক্ষ থেকে আইনি দলের মাধ্যমে তাঁর কাছে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। এর জবাবে ইমরান খান বলেন, গত বছরের আগস্টে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। তবে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তির কোনো সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এর আগে ইমরান খানের পক্ষ থেকে তাঁর সরকারের পতন ও তাঁকে কারাবন্দী করার পেছনে সেনাবাহিনীর হাত থাকতে পারে বলে অভিযোগ করা হয়।

ইমরান খান গার্ডিয়ানকে বলেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যেকোনো চুক্তি বা কোনো আলোচনার ক্ষেত্রে তা নির্দিষ্ট নীতি মেনে হবে। তা হবে জনগণের স্বার্থে। এতে ব্যক্তিগত কোনো অর্জন থাকবে না বা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষুণ্ন করে এ ধরনের আপস করা হবে না।

ইমরান খান আরও বলেন, ‘আমার নীতির সঙ্গে আপস করার চেয়ে বাকি জীবন কারাগারে কাটাব।’

এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছিলেন। দেশটির সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানের রাজনীতির কিংমেকারস হিসেবে দেখা হয়। একই সঙ্গে দেশটির গণতন্ত্রের পথে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে বড় বাধা হিসেবে দেখা হয়। ২০২২ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্কে চিড় ধরে। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। এরপর সেনাবাহিনীর সমালোচনা শুরু করেন তিনি। তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগও আনেন। এ ছাড়া তাঁকে কারাবন্দী রাখার জন্য তাদের অভিযুক্ত করেন।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে বর্তমানে ১০০টির বেশি মামলা রয়েছে। তিনি দাবি করেন, এসব মামলার পেছনে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক বিরোধীরা রয়েছে। বর্তমানে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা জোট সরকার গড়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায় রয়েছে। গত জুন মাসে ইমরান খানকে নির্বিচার আটকের বিষয়টি বেআইনি বলে ঘোষণা করে জাতিসংঘের একটি সংস্থা।

এরপরও ইমরান খানের কারাগারের জীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ইমরান খানের কণ্ঠে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার সুর শোনা যাচ্ছে। জুলাই মাসে ইমরান খান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শর্তমূলক আলোচনার কথা বলেছিলেন। তাঁর শর্ত ছিল, সেনাবাহিনীকে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন দিতে হবে। ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) দাবি করে আসছে, দেশটিতে ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল অগণতান্ত্রিক এবং নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল। তাদের দাবি, জনপ্রিয় ভোটে জিতেছিল পিটিআই।

তবে দেশটির জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা ইমরান খানের সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। একটি সামরিক সূত্র বলেছে, ইমরান খানকে আদালতের মামলাগুলোর মোকাবিলা করতে হবে। তিনি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কোনো চুক্তির প্রত্যাশা করতে পারেন না। ইমরান খান চান, প্রত্যেকে আইনের শাসন অনুসরণ করুন। কিন্তু তিনি নিজের জন্য সে নিয়ম চান না।

পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন বর্তমান জোট সরকারকে পেছন থেকে সামরিক বাহিনী সমর্থন দিচ্ছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে। গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে বর্তমান জোট সরকার সেনাপ্রধানের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো এবং সর্বোচ্চ আদালতের ওপর সরকারের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ নিতে সংবিধান সংশোধনীর পথে হাঁটছে। পিটিআইয়ের অভিযোগ, এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে সরকার এবং ইমরান খানের মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সংবিধান সংশোধনী ও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে এ সপ্তাহে ইমরান খান চূড়ান্ত ডাক দিয়েছেন। ২৪ নভেম্বর ইসলামাবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে তাঁর দল। ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তাঁর দলের নেতা–কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হচ্ছে। পিটিআইয়ের অধিকাংশ নেতা হয় কারাগারে, নতুবা তাঁরা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

ইমরান খানের বিচার বেসামরিক আদালত নাকি সামরিক আদালতে হবে, তা এখনো নিশ্চিত করেনি পাকিস্তান সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁর অধিকাংশই ঘুষ বা সন্ত্রাসবাদসম্পর্কিত। ইমরান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো বেসামরিক ব্যক্তিকে কীভাবে সামরিক আদালতে বিচার করা যায়, তিনি যদি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী হন? এটা হাস্যকর। সামরিক আদালতে কোনো বেসামরিক ব্যক্তির বিচার করার একমাত্র কারণ হলো, অন্য কোনো বিচার আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না।’

আদিয়ালা কারাগারে ইমরান খানকে যেভাবে রাখা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ইমরানের সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথ অভিযোগ করেছেন যে ইমরান খানকে নিঃসঙ্গবাস কক্ষে রাখা হয়েছে। ছেলের সঙ্গেও তাঁকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে ইমরান খানকে বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেনশিয়াল সুইটে’ রাখা হয়েছে। সেখানে তাঁর নিজস্ব রাঁধুনিও রয়েছে। ইমরান খান কোনো চিকিৎসাগত সুবিধা পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে রাখা হয়েছে যাতে কোনো মানুষের সংস্পর্শে তিনি না আসতে পারেন। তাঁর কক্ষে বিদ্যুৎ নেই এবং তাঁকে ২৪ ঘণ্টা হাজতে রাখা হয়েছে যেখানে সাধারণ স্বাধীনতাটুকুও নেই।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার বা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার বিষয়টি বিচারের স্বচ্ছতা বিঘ্নিত করছে বলে মনে করেন ইমরান খান।
তা সত্ত্বেও ইমরান খান বলেন, শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে জনগণের ইচ্ছা থাকলে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবেন।