<

ইরানে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে ফাঁস হওয়া নথি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দাগিরির প্রমাণ

ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে অতি গোপন মার্কিন গোয়েন্দা নথি অনলাইনে কীভাবে ফাঁস হলো, তা উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা।

গত শুক্রবার গোপন দুটি নথি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেখা যায়। তাতে ইরানে ইসরায়েলের হামলা পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন উঠে এসেছে।

স্যাটেলাইটে ধারণকৃত দৃশ্য ও অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ।

ইসরায়েলি কর্মকাণ্ড নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দাগিরির তথ্য এভাবে ফাঁস হওয়া নিয়ে গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’।

জন কিরবি আরও বলেন, নথিগুলো হ্যাক করা হয়েছে, নাকি অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় ফাঁস হয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি কর্মকর্তারা।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া, লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান নিহত হওয়াসহ আরও কিছু ঘটনায় ক্ষুব্ধ ইরান ১ অক্টোবর ইসরায়েলে দুই শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল তিন সপ্তাহ ধরে দেশটিতে হামলা চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে।

নথিগুলো কি আসল

সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নথিগুলোর শিরোনামে যেসব বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, দৃশ্যত তা সঠিক বলে মনে হচ্ছে। অতীতে যেসব গোপন নথি ফাঁস হয়েছে, সেসবের সঙ্গে মিল রয়েছে নথিগুলোর।

নথির শিরোনামে লেখা রয়েছে ‘টপ সিক্রেট’, আরও রয়েছে ‘এফজিআই’ লেখা। এফজিআই দিয়ে বোঝানো হয় ‘ফরেন গভর্নমেন্ট ইন্টেলিজেন্স’।

‘ফাইভ আইস’ (পাঁচ চোখ) জোটভুক্ত দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এসব নথি দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশ্চিমা মিত্র এ পাঁচ দেশ নিয়মিত নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে থাকে।

ফাঁস হওয়া নথি ‘টি কে’ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘টি কে’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘ট্যালেন্ট কিহোল’। এই কোডওয়ার্ডটি স্যাটেলাইটভিত্তিক সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (এসআইজিআইএনটি) ও ইমেজারি ইন্টেলিজেন্সের (আইএমআইএনটি) ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

নথি কী বলছে

ইরানে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্যের মূল্যায়ন করা হয়েছে নথি দুটিতে। মূল্যায়ন করেছে ‘ইউএস ন্যাশনাল জিওসপ্যাটিয়াল-ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ (মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীন একটি সংস্থা)।

নথিতে বিশেষত দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি ‘গোল্ডেন হরাইজন’ এবং অন্যটি ‘রকস’ নামে পরিচিত।

রকস হলো একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা, যা তৈরি করেছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান রাফাল। মাটির ওপর ও নিচের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে এটি। গোল্ডেন হরাইজন বলতে বোঝানো হয়েছে ব্লু স্প্যারো ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাকে। এটির পাল্লা প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২৪০ মাইল)।

নথিতে এ দুই ক্ষেপণাস্ত্রের কথা উল্লেখ করে এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ইস্ফাহানের কাছে ইরানের রাডার স্থাপনায় গত এপ্রিল মাসে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অনুরূপ হামলা সে দেশে চালানোর পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। তবে এবারের হামলা হবে অনেক বেশি বিস্তৃত পরিসরের।

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এ হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো জর্ডানের মতো নির্দিষ্ট কিছু দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করা এড়াতে সক্ষম হবে।

নথিতে এ–ও উল্লেখ করা হয়, ইরানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে নিজস্ব পারমাণবিক ব্যবস্থা সক্রিয় করার কোনো প্রস্তুতি ইসরায়েল নিচ্ছে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

ইসরায়েলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কখনোই জনসমক্ষে এটি স্বীকার করে না, তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশটি পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। এ অবস্থায় নথিতে উল্লেখ করা ওই তথ্য ওয়াশিংটনের জন্য কিছু না কিছু হলেও বিব্রতকর।

নথিতে যা বলা হয়নি

নথিতে নির্দিষ্ট দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হলেও ইরান বা অন্য কোনো দেশে এ হামলার লক্ষ্যবস্তু কী, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ইরানের পারমাণবিক বা তেল স্থাপনা হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানোর বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করেনি।

হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ইরানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি বিশেষ করে, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ও এর সহযোগী বাসিজ মিলিশিয়া গোষ্ঠীর ব্যাপারেও কিছু উল্লেখ করা হয়নি এসব নথিতে। এ দুই প্রতিষ্ঠানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ইরানের বাইরে বিদেশের মাটিতেও প্রতিষ্ঠান দুটির তৎপরতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েল যেকোনো মুহূর্তে তেহরানের হামলার প্রতিশোধ নিতে পারে। গত এপ্রিলে দেখা গেছে, ইসরায়েলের আক্রমণের জবাবে দেশটিতে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে ১২ দিন অপেক্ষা করেছে ইরান। ইরানের ওই হামলার আগে সিরিয়ার দামেস্কের কূটনৈতিক এলাকায় বিমান হামলা চালিয়ে ইরানি বিপ্লবী গার্ডের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারকে হত্য করে ইসরায়েল।

আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর আগে ইরানে হামলা হলে তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে—এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের প্রেক্ষাপটেই হয়তো ইসরায়েল এ মুহূর্তে তেহরানে হামলার বিষয়ে কালক্ষেপণ করছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেমনটা মনে করা হচ্ছে, নথিগুলো যদি তেমনটা সত্যিই হয়ে থাকে, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক থাকার পরও ওয়াশিংটন যে এখনো তার মিত্রদেশের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করে থাকে, সেটিই প্রমাণিত হবে।

সংক্ষেপে, নথিগুলোর ভাষ্য, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলা হবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এবং তা হবে অত্যাধুনিক।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ইসরায়েল যেখনই ইরানে তার হামলার পরিকল্পনা কার্যকর করুক না কেন, মধ্যপ্রাচ্য আরেক দফা চরম উত্তেজনার মধ্যে পড়বে।