<

মানসম্পন্ন শিক্ষার সন্ধানে

বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষার তাগিদ অনুভব হয়েছে। এটি দেশের জন্য ইতিবাচক। কারণ, যেকোনো লক্ষ্য পূরণ টেকসই হতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা একটা পূর্বশর্ত। এই তাগিদের পেছনে এসডিজি পূরণের বাধ্যবাধকতা ভূমিকা রেখেছে।

আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকার শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অভীষ্ট অর্জিত হয়নি। আমরা বদলাতে পারিনি পরীক্ষানির্ভর মুখস্থবিদ্যার কাঠামো। এটি আসলে মৌলিক সংস্কারের বিষয়। তাই এ রকম কাজের জন্য সব অংশীজনের মতামত ও সহযোগিতা জরুরি বিষয়। যে ব্যবস্থাটি ২০২১ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল (ও বর্তমানে বাতিল হলো), সেটি সরকারের অনুমোদনে হলেও (শুনেছি অনেক মন্ত্রী ও আমলার সায় ছিল না) অংশীজনদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিভ্রান্তি, বিতর্ক, ভিন্নমত আছে। অন্তর্বর্তী সরকার আগের ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

সুদীর্ঘকালের ব্যবস্থাটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কেউই সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি জরিপ, গবেষণা ও মূল্যায়নে বারবার এ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা (বা ব্যর্থতা) উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কী ঘটে গেল যে সেখান থেকে আর বিদ্যাসাগর থেকে আনিসুজ্জামান, জগদীশচন্দ্র বসু থেকে জামাল নজরুল ইসলামের মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটছে না?

গত শতকের ষাটের দশক থেকে অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধিই চলমান ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরির মূল কারণ। আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে ব্যবস্থাটি অকার্যকর হতে শুরু করে। শিক্ষার বিস্তার ঘটলেও তাতে যে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। কোনো সরকারই তা নিরসনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে শ্রেণিকক্ষে স্থান সংকুলান সমস্যা, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অকার্যকর অনুপাত, শিক্ষকদের দারিদ্র্য ও মর্যাদার অবনমন পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।

বাস্তবতা ও চাহিদার এই তারতম্যের ফলে শিক্ষার এক অদ্ভুত রূপান্তর হয়েছে। পড়াশোনার চেয়ে পরীক্ষা, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোট-গাইড বই, স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার, শিক্ষকের চেয়ে কোচ-টিউটরই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের শিক্ষাযাত্রায়। এভাবে শিক্ষার পণ্যায়ন হলো, শিক্ষার্থীরা পরিণত হলো পরীক্ষার্থীতে এবং শিক্ষার অর্থ হলো জিপিএ–৫ অর্জন! একজন শিক্ষার্থীর পঠনপাঠন কেবল পাঠ্যবইতেও নয়, তার থেকে বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল! এ রকম সীমিত পঠনপাঠনে আর যা–ই হোক জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কারও জন্যই তৃপ্তিদায়ক ছিল না।

শিক্ষার এ পরিণতি কাম্য নয়। ফলে অনেকেরই মনে হয়েছে, একটা বড় ঝাঁকুনি বা বিপ্লবী পরিবর্তন দরকার। যে ব্যবস্থাটি এখন বাতিল হতে চলেছে, তার মধ্যে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনার উপাদান ছিল বলেই মনে হয়েছে। কেবল একটু সময় নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদেরও সঙ্গে নিয়ে কাজে নামা উচিত ছিল। এতে কী ধরনের গুণগত পরিবর্তনের উপাদান ছিল, স্বল্পকথায় তার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যায়।

এত কালের চলমান শিক্ষাব্যবস্থাটিতে শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়েছিল প্যাসিভ লার্নার বা নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী। তাদের মূল কাজ হয়ে ওঠে অন্যের প্রশ্নের অন্যের তৈরি উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ঠিকঠাক লিখে ভালো নম্বর আদায় করা। অভিজ্ঞতাভিত্তিক যে শিক্ষাপদ্ধতিটি চালুর চেষ্টা হয়েছিল, তা শিক্ষককেন্দ্রিক না হয়ে ছিল শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের হতে হয় অ্যাকটিভ লার্নার বা সক্রিয় জ্ঞানান্বেষী। তারা গোড়া থেকেই জ্ঞানচর্চার মৌলিক দুটি প্রক্রিয়ায় ধাতস্থ হয়ে যায়—পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান। জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবেই তাদের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটে। তারা বুঝতে পারে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বাড়তি বই পড়ার মাধ্যমে জানার ভিত শক্ত ও পরিসর বাড়ানো যায়।

এ ব্যবস্থায় শিক্ষার আনুষঙ্গিক কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তবে কাজ করার অভিজ্ঞতা, গুণাবলি চর্চা ও অর্জনের সুযোগ পায়। এর মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বের ক্ষমতা বা দলবদ্ধ কাজের উদ্দীপনা সহজেই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারা হয়ে ওঠে ছোট ছোট উদ্যোগী মানুষ। এভাবে একটি নিষ্প্রাণ ব্যবস্থায় প্রাণের সঞ্চার হয়। একটি নিরানন্দ পরিবেশ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনায় এত কালের ব্যবস্থায় শিশু-কিশোরদের সামগ্রিক মানবিক বিকাশে ব্যর্থতা-বন্ধ্যাত্বের কথা উঠে আসে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ ছিল এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এ ব্যবস্থা ছিল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, লেখক প্রমুখ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নতুন। এ ব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান হয়ে তাঁদের কাজ বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীর জ্ঞানচর্চার অগ্রগামী হিসেবে তাঁকে হতে হয় সৃজনশীল, সার্বক্ষণিক বুদ্ধি-পরামর্শদাতা, বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে সব রকম বাধা দূর করার সহায়তাকারী ইত্যাদি। জ্ঞানের দিক থেকেও তাঁকে সচল থেকে অগ্রসর হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। কারণ, এ ব্যবস্থায় তামাদি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে দু-তিন বছরের মধ্যেই নোট-গাইড বই ও কোচিং সেন্টার ব্যবসায়ে এ পদ্ধতির প্রভাব পড়া শুরু হয়েছিল। বোঝা যায়, পদ্ধতিটি শিক্ষক-অভিভাবক সবার অংশগ্রহণে সচল হলে এসবের প্রয়োজন আর থাকত না। তবে বর্তমান কাঠামো ও মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া এ রকম পদ্ধতি সফল হবে না। শ্রেণিকক্ষের পরিসর বাড়াতে ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমাতে হবে। এক শ্রেণি–শাখায় ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থী রাখা যাবে না। মেধাবী তরুণদের স্কুলশিক্ষকের পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে।

প্রয়োজন প্রতিটি স্কুলে সমৃদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণাগার। দিতে হবে শ্রেণি কার্যক্রমের জন্য স্কুলভিত্তিক বরাদ্দ। শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের কাজটি আদতে একটি চলমান কাজ। এ কাজ কেবল দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দিয়ে সার্থকভাবে করা যাবে না। তাই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশনের সদস্যরা অংশীজনদের মতামত নিয়ে জাতির শিক্ষাযাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার কাজ করবেন। প্রতি দু-তিন বছরে কমিশন নবায়ন হতে পারে। এভাবে শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা ও ফলাফলকেন্দ্রিক যে সামাজিক ধারণা, তা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

শেষে আবার বলতে হয় যে এখন আর যোগাযোগ বা জ্বালানি খাতের বড় অবকাঠামোতে নয়, মেগা প্রকল্প প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়নে, যার মূলভিত্তি হবে শিক্ষা, বিশেষত স্কুলশিক্ষা। এ খাতে বাজেট বরাদ্দ না বাড়ালে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।