<

আন্দোলনকালে গুলিবিদ্ধ শিশু মুসাকে সিঙ্গাপুরে নিতে বলছেন চিকিৎসকেরা, কে দেবে এত টাকা

‘উই নেভার লুজ হোপ’ (আমরা কখনো আশা ছাড়ি না)। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (পিআইসিইউ) প্রবেশদ্বারে এমন একটি বার্তা লেখা। এই আইসিইউতে সাত বছরের শিশু বাসিত খান মুসাকে নিয়ে ‘আশা না ছাড়ার’ লড়াই করছেন মা–বাবা ও চিকিৎসকেরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাসার নিচে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় মুসা। তাকে নিয়ে ৮১ দিন ধরে চলছে এই লড়াই। এই সময়ের মধ্যে অল্প কয়েক দিন ছাড়া শিশুটি পুরোটা সময় লাইফ সাপোর্টে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির তথ্যমতে, এই আন্দোলনে আহত হয়ে এই মুহূর্তে যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মুসা।

চিকিৎসকদের ভাষ্য, উন্নত চিকিৎসার জন্য মুসাকে এখন সিঙ্গাপুরের মতো দেশে পাঠানো দরকার। তাঁরা আশা করছেন, উন্নত চিকিৎসায় শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু এই আশার সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা—অর্থসংকট। বিদেশে চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তা কে দেবে?

মুস্তাফিজুর রহমান ও নিশামণি দম্পতির একমাত্র সন্তান মুসা। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকার বাসার নিচে গুলিবিদ্ধ হয় মুসা ও তার দাদি মায়া ইসলাম (৬০)। তিনি মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাসার নিচে নেমেছিলেন। তখন দুজনেই গুলিবিদ্ধ হয়।

মায়া ইসলাম পরদিন মারা যান। আর মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মুসাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। দুই দিন পর তাকে ওয়ার্ডে দেওয়া হয়। এর দুই দিন পর তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।

গত ১৪ আগস্ট বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে মুসাকে দেখতে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। সে সময় তারা মা–বাবা জানিয়েছিলেন, টানা ২৩ দিন মুসা অচেতন ছিল।

গত ২৬ আগস্ট মুসাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সিএমএইচের নিউরোসার্জারি বিভাগে (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) স্থানান্তর করা হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর তাকে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগে।

৫ অক্টোবর সিএমএইচের পিআইসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হয় মুসার মা নিশামণির সঙ্গে। চিকেন ফ্রাই আর ‘স্পাইডারম্যান’ভক্ত ছেলের অসংখ্য ছবি তাঁর মুঠোফোনে—স্পাইডারম্যানের পোশাক ও মুখোশ পরে, ব্যাগ নিয়ে দুষ্টুমিমাখা ছবি। বাবার সঙ্গে চিকেন ফ্রাই খেতে থাকা ছবি। এসব ছবি এখন নিশামণির মনঃকষ্ট বাড়াচ্ছে।

ছেলে এখন মাঝেমধ্যে মায়ের দিকে তাকালেও কিছু বলে না। গত ৮১ দিন ধরে হাসপাতালেই দিনরাত কাটছে এই মায়ের। তিনি হাহাকার নিয়ে বলেন, একমুর্হূর্তে তাঁর ছোট্ট পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ছেলের জন্য এখন উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত সরকারি সহায়তায় চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু এই চিকিৎসা মুসার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে মুসার চিকিৎসা আর নেই। চিকিৎসকেরা তাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে বলছেন। কিন্তু তাঁদের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই।

ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর আকুলতা নিয়ে নিশামণি বলেন, ‘আমার ছেলে কি রাষ্ট্রের জন্য এতই বোঝা! সরকার কি পারে না ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে! ওর চিকিৎসার টাকা দেওয়ার কি কেউ নেই!’

চিকিৎসকেরা যা বলছেন

চিকিৎসকদের কাছ থেকে জানা গেছে, গুলি মুসার মাথার বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে বের হয়ে গেছে। তার মাথায় কোনো গুলি নেই। তবে গুলিতে মুসার মস্তিষ্ক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার শরীরের ডান পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মাথায় এখন অতিরিক্ত পানি তৈরি হচ্ছে। সাময়িকভাবে এই পানি বের করে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের পদ্ধতি ১৫ দিনের জন্য কার্যকর হয়। তবে এতে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, আজ সোমবার মুসার শান্ট সার্জারি করা হবে। এর মাধ্যমে বাইপাস করে পানি মস্তিষ্ক থেকে পরিপাকতন্ত্রের পেরিটোনিয়ামে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে এটাও সাময়িক পদ্ধতি। এটা এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত রাখা যায়।

সিএমএইচে মুসা মূলত জ্যেষ্ঠ নিউরোসার্জন অধ্যাপক কর্নেল মো. আল আমিন সালেক ও পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদের অধীন চিকিৎসা নিচ্ছে।

পরিবার জানায়, অধ্যাপক কর্নেল মো. আল আমিন সালেক গত ২৬ সেপ্টেম্বর মুসার ভবিষ্যৎ চিকিৎসার পরিকল্পনা তুলে ধরে শিশুটির উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন। লিখিত সুপারিশে তিনি বলেছেন, মুসার চিকিৎসায় আরও ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য তাকে উন্নত জায়গায় পাঠানো দরকার। এ পরিস্থিতিতে বিদেশে স্থানান্তরের জন্য তার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা লাগবে।

অধ্যাপক সালেকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সুপারিশ লিখিত আকারে দিয়েছি রোগীর অভিভাবকের কাছে। মাথায় আঘাতের কারণে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন।’

সিএমএইচের প্রশাসনিক ব্লকে বসে ৫ অক্টোবর কথা হয় আরেক চিকিৎসক অধ্যাপক নাজমুল হামিদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুসার মস্তিষ্কে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ছাড়া সে শ্বাস নিতে পারছে না। তার খিঁচুনিও আছে। এ অবস্থায় আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, মুসাকে যেন সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। ৭ অক্টোবর (আজ) মুসার বিষয়ে কথা বলতে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে জুমে সভা করব আমরা।’

নাজমুল হামিদ আরও বলেন, ‘মুসাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখাই নয়, সে যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য সিঙ্গাপুরই হতে পারে সবচেয়ে ভালো জায়গা। মাঝেমধ্যে সে ভালোই সাড়া দেয়। এতে আশা জেগেছে যে আরও উন্নত চিকিৎসায় সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। মহান আল্লাহ এত দিন ধরে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বেশ কয়েকবার শিশুটির অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যাওয়ার পরও বেঁচে আছে। তাই আশা জাগে, কোনোভাবে তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে পারলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। সেখানে এই চিকিৎসা রয়েছে।’

আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি। এই উপকমিটির সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি নুসরাত জাহানের কাছে মুসার চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুটিকে আমরা দেখে এসেছি। তার চিকিৎসা নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।’

কবে আলোচনা করা হবে, তা জানতে চাইলে নুসরাত জাহান বলেন, ‘সেটা এখনো ঠিক হয়নি।’

সিএমএইচ থেকে বের হওয়ার সময় মুসার মা নিশামণির কথাগুলো বারবার কানে বাজছিল। একই সঙ্গে মুসার নিষ্পাপ মুখটি চোখে ভাসছিল।

মুসার এখন মা-বাবার সঙ্গে আনন্দে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে চঞ্চলতায় মেতে থাকার কথা ছিল। অথচ সে রাজনীতির নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে এখন হাসপাতালের শয্যায় বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে। তবু তার ঘুরে দাঁড়ানোর, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন সহায়তার হাত।

তবে মুসার মায়ের আকুলতায় সরকার, সমাজ কতটা সাড়া দেবে, তা পরিবারটির জানা নেই। মুসার মা আবেগপ্রবণ হয়ে ধরা গলায় এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘যদি মুসা মরে যায়, তাহলে আমার জন্যও একটা বুলেট রেখে দিয়েন আপনারা।’