গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই—এ মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের শোভাযাত্রার উদ্বোধন করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরেরা দেশে–বিদেশে ও প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
নয়াপল্টন থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ—প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বিএনপি জনশক্তি প্রদর্শন ও অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিল। শোভাযাত্রার উদ্বোধনী বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এই মিছিল দেশের স্বার্থ রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার রক্ষার মিছিল।
বিকেল পৌনে পাঁচটার পর শোভাযাত্রার সম্মুখভাগটি যখন মানিক মিয়া পৌঁছায়, তখন একটি মিনি ট্রাকের ওপর বানানো অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী মাইকে আগন্তুকদের উদ্দেশে বলেন, নয়াপল্টন থেকে সংসদ ভবনের সামনে এই শোভাযাত্রা কেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে জাতীয় সংসদ। এত দিন মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তারা ভোট দিয়ে এই সংসদে জনগণের প্রতিনিধি পাঠাতে চায়। এই বার্তা আমরা দিতে চাই। এটাই এই র্যালির উদ্দেশ্য।’
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস উপলক্ষে বিএনপি এ শোভাযাত্রা বের করে। বেলা সাড়ে তিনটায় নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যায় সোয়া ছয়টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটায়ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর উদ্দেশে যাত্রা করা শোভাযাত্রার মিছিল কারওয়ান বাজার এলাকা পার হতে দেখা যায়। বিএনপির নেতারা এটাকে স্মরণকালের বড় শোভাযাত্রা বলে মন্তব্য করেন।
‘এই মিছিল দেশের স্বার্থ রক্ষার মিছিল’
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর আগে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
তারেক রহমান বলেন, রাজপথে লাখো জনতার এ মিছিল দেশের স্বার্থ রক্ষার মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার রক্ষার মিছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেন আর কখনোই ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেক নাগরিক সরাসরি ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সক্ষমতা অর্জন করলেই তা সম্ভব।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি মুখাপেক্ষী না করা পর্যন্ত মানুষ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে, যদি মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে না পারি।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারও স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই, সেটি হলো গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরেরা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনো সক্রিয়।’
তারেক রহমান আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল শত্রু-মিত্র চেনার দিন। আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের শত্রু চিহ্নিত করার দিন। বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না।
বড় শোভাযাত্রা, সড়কে যানজট
শোভাযাত্রার আগে বেলা দুইটায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত অস্থায়ী মঞ্চে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে দুপুর থেকেই হাজার হাজার নেতা-কর্মী খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে জড়ো হন। নয়াপল্টন ছাড়াও নেতা-কর্মীরা পশ্চিমে নাইটিঙ্গেল, কাকরাইল মোড় হয়ে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত, পূর্ব দিকে ফকিরাপুল মোড় হয়ে আরামবাগ, নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের যাঁর যাঁর সংগঠনের ব্যানার নিয়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটির সব থানা-ওয়ার্ড ছাড়াও ঢাকার আশপাশের আটটি জেলার নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বাস ভাড়া করে এসে অংশ নেন।
হাজার হাজার নেতা-কর্মীর এ সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে, গান-বাজনা বাজিয়ে রংবেরঙের ক্যাপ ও টি-শার্ট পরে নেতা-কর্মীরা শোভাযাত্রা করেন। এর মধ্যে শেখ হাসিনাকে প্রতীকী লোহার খাঁচায় বন্দী করে উপস্থাপন করা হয়। খাঁচার গায়ে একাধিক প্ল্যাকার্ডও ঝুলিয়ে দেওয়া হয় । এতে লেখা, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম রাক্ষসী’, ‘আমি দলের সমস্ত নেতাকর্মীদের ফেলে পালিয়ে যাই’, ‘আমি নিরপরাধ ও নির্দোষ মানুষ গুম করি’, ‘আমি ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে দেশকে ধ্বংস করি’, ‘আমি নিরপরাধ ছাত্র খুনি’ এমন নানা রকমের বাক্য। শোভাযাত্রায় এটি অনেকের দৃষ্টি কাড়ে।
শোভাযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও দুপুর থেকেই রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড় থেকে বাংলামোটর হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নয়াপল্টনের আশপাশের এলাকায় দুপুরের পর থেকেই ছিল তীব্র যানজট। সন্ধ্যায়ও ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে মানুষকে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রাটি কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্য ভবন-ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশন-শাহবাগ-হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। বিএনপির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু খোলা ট্রাকে এ মিছিলে অংশ নেন।
দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে
শোভাযাত্রা শুরুর আগে নয়াপল্টনে ও শেষে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সভাপতির বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নয়াপল্টনে তিনি বলেন, ‘এই ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দিন। আপনাদের নিশ্চয় জানা থাকার কথা, ৭ নভেম্বরের আগে ৩ নভেম্বর একটা অভ্যুত্থান হয়েছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। খালেদ মোশাররফের লক্ষ্য ছিল আবার আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করা, একদলীয় শাসনে দেশকে নিয়ে যাওয়া।’
মির্জা ফখরুল বলেন, এ দেশের দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনগণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁদের পরাজিত করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন ইতিহাস রচনা করে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে এ বছর আমরা আরেকটা অভ্যুত্থান দেখেছি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্বে পরিণত করেছিল। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ছাত্র-জনতা অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ সৃষ্টি করবার প্রয়াস পায়।’
সন্ধ্যা ছয়টায় মির্জা ফখরুল ইসলামসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মানিক মিয়া পৌঁছান। সেখানে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাস বক্তব্য দেন। বিশাল শোভাযাত্রার কথা উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা সামনে ঘোলাটে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। যদি এ রকম কিছু হয়, এই র্যালি প্রমাণ করে আমরা সবকিছু মোকাবিলা করতে পারব। বিগত দিনে আপনারা ফ্যাসিবাদের যেমন পতন ঘটিয়েছেন, আগামী দিনেও যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারবেন।’
সমাপনী বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে আমরা আহ্বান জানাব, আজকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষার করার জন্য, গণতন্ত্রকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমরা লড়াই করেছি। আমাদের ছেলেরা রক্ত দিয়েছে। সেই রক্তের ঋণ, তাদের আত্মত্যাগ এবং তাদের যদি আমরা সম্মান দেখাতে চাই, তাহলে অতি দ্রুত সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটা জনগণের সংসদ গঠন করতে পারব, জনগণের সরকার গঠন করতে পারব।’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ৭ নভেম্বরের শোভাযাত্রা কর্মসূচি বিএনপিকে নানা শর্ত সাপেক্ষে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত করতে হতো। এক যুগের বেশি সময় পর এবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত শোভাযাত্রা করল বিএনপি।