<

‘আব্বারে দেখবার দেও, তোমরা আমারে আটকাইয়ো না’

ময়মনসিংহ নগরে সিএনজি ফিলিং স্টেশনে বিস্ফোরণে নিহত তিনজনের বাড়িতে মাতম চলছে। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিহতের স্বজনেরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।

গত সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে ময়মনসিংহ নগরের রহমতপুর বাইপাস এলাকায় আজহার ফিলিং স্টেশনে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে সাতটি গাড়ি পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে তিনজন নিহত হন। গুরুতর আহত চারজন ঢাকায় ও দুজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।  

এদিকে, ফিলিং স্টেশনটিতে বিস্ফোরণের পর থেকে গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এ অবস্থায় সেখানে ৫০০ মিটার এলাকায় যানবাহন ও মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সোমবার রাত ১১টার দিকে জেলা প্রশাসন থেকে এ বিষয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটির গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
এ সম্পর্কে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এখানে একধরনের গাফিলতি রয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’  

বাবাকে দেখতে চায় শিশু আমাতুন
সোমবার দুপুরে খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে প্রাইভেট কার নিয়ে বের হন হিমেল আহমেদ (৩২)। বাড়ির অদূরে ফিলিং স্টেশনে গ্যাস নিতে গিয়ে বিস্ফোরণে পুড়ে নিহত হন তিনি। সদর উপজেলার কিসমত গ্রামে তাঁর বাড়ি। তিনি প্রাইভেট কার চালাতেন। স্ত্রী, মেয়ে, মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে তাঁর সংসার।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে হিমেলের মরদেহ আনা হয় বাড়িতে। তখন স্বজন ও এলাকাবাসী আহাজারি শুরু করেন। মরদেহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে বাড়ির সামনে খাটিয়ায় রাখা হয়। পোড়া মরদেহ কাউকে দেখতে দেওয়া হচ্ছিল না। হিমেলের ১০ বছর বয়সী মেয়ে আমাতুন নূর হিফা আহাজারি করে বলতে থাকে, ‘আমার আব্বারে দেখবার দেও; তোমরা আমারে আটকাইয়ো না। আব্বাতো কইছিলো টিম (ট্রিপ) মাইরা আওনের সময় আমার লাইগ্যা মজা লইয়া আইবো।’

স্ত্রী ফাহিমা আক্তার বলেন, ‘আমার সংসারের একজনই গারজিয়ান (অভিভাবক)। একটা মাইয়া থুইয়া গেছে গো। অবৈধভাবে গ্যাস পাম্প চালাইছে। এ কারণে আমার স্বামী মরছে।’  

হিমেল আহমেদের মামা সাজ্জাদ হোসেন খান বলেন, ‘এক সঙ্গে তিন ধরনের জ্বালানি নিয়ে পাম্প চলতে পারে না৷ এলপি গ্যাসের ট্যাংক থেকে গ্যাস রাতের বেলায় আনলোড করার কথা। কিন্তু দিনের বেলায় আনলোড করা হয়। আগুন নেভানোরও কোনো ক্যাপাসিটি নেই। আমার ভাগনে মারা গেছে। এর বিচার চাই।’  

দগ্ধ হয়ে মেয়ের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন আবদুল কদ্দুস
ভাঙারি কুড়িয়ে ও মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চলতেন আবদুল কদ্দুস (৮৫)। ফিলিং স্টেশনে বিস্ফোরণে তিনিও মারা গেছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বেলা তিনটার দিকে তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় সদর উপজেলার কিসমত গ্রামে নিজ বাড়িতে।

স্বজনেরা জানান, আবদুল কদ্দুস রহমতপুর এলাকায় মেয়ে ময়না আক্তারের বাসায় বসবাস করতেন। ময়না আক্তার (৩৭) বলেন, সোমবার দুপুরে ১২টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যান বাবা। মসজিদে নামাজ পড়ে হোটেলে ভাত খেয়ে পাম্পের কোনে প্রতিদিন বসে থাকেন, চা খান। গতকাল বিস্ফোরণে আগুনে তাঁর শরীর পুড়ে যায়। দগ্ধ শরীরে তাঁর বাসার দিকে হাঁটে আসছিলেন। তাঁকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেননি। শরীরে কোনো পোশাক ছিল না। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখেন, তাঁর বাবা। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

ময়না আক্তার বলেন, ‘পাম্পের মানুষ অপরাধ করেছে, আমরা এর শাস্তি চাই। কেন দিনের বেলায় গ্যাস আনলোড করে এতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া হলো?’

আবুল হোসেনকে হারিয়ে অথই সাগরে পরিবার
ফিলিং স্টেশনটির এক কোনায় মুদিদোকান ছিল আবুল হোসেনের (৪৫)। তিনি নগরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের হারগোজিরপাড় এলাকার মনসুর হোসেনের ছেলে।

বিস্ফোরণে দগ্ধ হওয়ার পর আবুল হোসেনকে প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। সোমবার রাত ১২টার দিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। রাতেই তাঁর মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

নিহতের ভাই মিয়া হোসেন বলেন, গতকাল সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁর ভাইকে দাফন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত করা হয়নি। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবারকে অসহায় হয়ে পড়েছে।

গতকাল বিকেলে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী লাভলী আক্তার, বড় মেয়ে মৌসুমী আক্তার (২৪), মিম আক্তার (১৪) কাঁদছেন। বাবা মারা গেছে তা বোঝার ক্ষমতা নেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে লামিয়া আক্তারের (১২)। লাভলী আক্তার বলেন, ‘আমাদের সব শেষ অইয়া গেল। মানুষও শেষ অইয়া গেল, দোকানও পুড়ে শেষ অইলে গেল।’

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ যা জানাল
তিতাস গ্যাস ময়মনসিংহের ডিজিএম সুরঞ্জিত কুমার দে গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সরেজমিন ঘুরে একটি প্রতিবেদন দেব। এখানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ ছাড়াও এলপি গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম ছিল। অনুমতি নিয়ে প্রথমে গ্যাসের করা হলেও পরে পেট্রোলিয়াম ও এলপি করা হয়। সেটি করার সুযোগ আছে কি না, তা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। দুর্ঘটনাটি প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে হয়নি। পাম্পটিতে সিএনজির সঙ্গে একটি এলপিজি ইউনিট রয়েছে।’

ফিলিং স্টেশনের মালিক লাপাত্তা
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম খান বলেন, ঘটনার পর থেকে পাম্পের মালিক পলাতক রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে দুজনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একজনের মরদেহ স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছেন।