যতই দিন যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ততই আরো বেশি জটিল ও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে যা অনেক বেশি সংকটময় আর ভয়াবহ। সংঘাতে লিপ্ত যে কোনো পক্ষের সামান্যতম ভুল এক পদক্ষেপ মুহূর্তেই বিশ্বের জন্য বয়ে আনতে পারে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।
এক কথায় বলা যায়, এই মুহূর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো উত্তেজনা কমানোর জন্য সব পক্ষকে চাপ দিচ্ছে। আর, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে দ্রুত সংঘাত বন্ধের আহবান।
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে শুরু করে ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে ইসরাইল। একই সাথে একাধিক ফ্রন্টে লড়ছে দেশটি। হিজবুল্লাহ প্রধানসহ শীর্ষ নেতাদের ও তেহরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ডারকে হত্যার কারণে এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ইরানও। এরইমধ্যে দেশটি ইসরাইলের মাটিতে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরানে পাল্টা হামলা চালানোর ছক কষে চলেছে তেল আবিব।
অন্যদিকে, লেবাননে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার অভিযোগও উঠেছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ইসরাইলের হাতে থাড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তুলে দিলো দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি এই ক্ষেপণাস্ত্র চালানোর জন্য ইসরাইলে নিজেদের ১০০ সেনাও মোতায়েন করতে যাচ্ছে আমেরিকা। যা পশ্চিম এশিয়ার সংঘাতে যোগ করতে চলেছে নতুন মাত্রা।
এই পদক্ষেপ ইসরাইলের প্রতিরক্ষা এবং দেশটিতে আমেরিকানদেরকে ইরানের যেকোনো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে রক্ষা করবে বলে মনে করছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান বার্তা দিয়েছে তারা যেন তাদের সেনাদের ইসরাইলে না পাঠায়। এতে তাদের সেনারা ঝুঁকিতে পড়বে।
তবে ইসরাইলের হাতে বর্তমানে বেশ কয়েকটি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলো হলো- ডেভিডস স্লিং, অ্যারো-২, অ্যারো-৩ ও আয়রন ডোম। অ্যারো-৩-এর কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে থাডের মিল রয়েছে। আকাশ প্রতিরক্ষায় থাড কেন গুরুত্বপূর্ণ? তাহলে এবার একনজরে জেনে নেওয়া যাক থাডের আদ্যোপান্ত।
টার্মিনাল হাই-অল্টিচিউড এরিয়া ডিফেন্স’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হল THAAD। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ও দুর্ধর্ষ ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী সমরাস্ত্র। থাড এমন এক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম যেখানে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে থাকা অবস্থাতেই সেটিকে ধ্বংস বা ভূপাতিত করতে পারে। এটি শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের কাছাকাছি বিস্ফোরিত না হয়ে সরাসরি এতে আঘাত হানতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী ব্যবস্থাগুলোর একটি হলো থাড। যেটি স্বল্প ও মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে। এছাড়া মধ্য ও দূরপাল্লার মাঝামাঝি (ইন্টারমিডিয়েট) শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসেরও সক্ষমতা রয়েছে এটির। থাড আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ও বাইরে- দুই জায়গায় থাকা ক্ষেপণাস্ত্রই ধ্বংস করতে পারে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি পরিচালনা করতেই প্রয়োজন পড়ে প্রায় ১০০ সেনার।
এতে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক রাডার। মূলত শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থার কারণে থাড খুবই নির্ভুলভাবে প্রতিপক্ষের হামলা নস্যাৎ করতে পারে। এই রাডার ব্যবস্থার নাম ‘এএন/টিপিওয়াই-২’। সুবিধা অনুযায়ী এই রাডার থাডের ব্যাটারি, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যুদ্ধজাহাজ বা অন্য কোনো স্থাপনায় স্থাপন করা যেতে পারে। সেখান থেকেই শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে তথ্য পাঠাতে পারে এই রাডার। প্রত্যেক লঞ্চার থেকে একবার উৎক্ষেপণের পর ৩০ মিনিট সময় লাগে ফের হামলার উপযোগী করতে।
শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা যুদ্ধবিমান ধ্বংসের জন্য থাড-এর রয়েছে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র। এটি ৮৭০ থেকে ৩০০০ কিলোমিটার দূর থেকে হুমকি বা বিপদ শনাক্ত করতে পারে এবং নিজের ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে আসা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিমেষেই ধ্বংস করতে পারে।
পরীক্ষামূলকভাবে থাড-এর সফলতার হার প্রায় নিখুঁত। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিসাইল থ্রেট প্রজেক্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উৎপাদন করা থাড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে কখনোই লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে ব্যর্থ হয়নি। এ প্রযুক্তিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটি মিসাইল ছোড়া হয়েছিল। যা মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে সেটি ধ্বংস করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘লকহিড মার্টিন মিসাইলস অ্যান্ড ফায়ার কন্ট্রোল’ ২০০৮ সালে থাড তৈরি করে। তবে, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নকশা ১৯৮৭ সালেই করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল ডিফেন্স বিভাগ। ১৯৯১ সালে সেই নকশা প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি লকহিড মার্টিন থাডের সফল পরীক্ষা চালায়।
৯০০ কিলোগ্রাম ওজনের থাড মিসাইলের উচ্চতা ২০ ফুট ৩ ইঞ্চি। এটি মূলত Hit to kill technology ‘MIM-104 Patriot PAC-3 ‘- এর মতো। যদিও PAC-3 তে সামান্য বিস্ফোরক থাকে যা থাডে থাকে না। এর মিসাইলগুলোর গতি ৮.২৪ ম্যাক যা সেকেন্ডে ২.৮ কি.মি. আর ঘণ্টায় ১০ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। এর গাইডেন্স ব্যবস্থায় বসানো হয়েছে ইন্ডিয়াম অ্যান্টিমোনাইড ইমেজিং ইনফ্রারেড প্রযুক্তি।
বিস্ময়কর এ প্রযুক্তিতে কোনো ওয়ারহেড প্রয়োজন হয় না। ব্যবহার করা হয় কাইনেটিক এনার্জি। এটি গতিশক্তি ব্যবহার করে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে। যদি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়, শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্পত্তি করার জন্য, এটি বিস্ফোরক ব্যবহার না করে শক্তি বা শক্তি প্রয়োগ করে আক্রমণ করে। লকহিড এখন থাড ব্যবস্থায় হাইপারসনিক প্রযুক্তি যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্যমতে, দেশটির হাতে বর্তমানে থাডের সাতটি ‘ব্যাটারি’ রয়েছে। প্রতিটি ব্যাটারিতে রয়েছে সাতটি করে ট্রাক। প্রতিটি ট্রাকে আবার যুক্ত করা আটটি ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া প্রতিটি ব্যাটারিতে একটি শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপণ ও যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে।
‘অ্যাজিস’ ও ‘প্যাট্রিয়টের’ মতো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে থাড। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর ‘সি-১৭’ ও ‘সি–৫’ উড়োজাহাজের মাধ্যমে দ্রুত যে কোনো স্থানে মোতায়েন করা যায়।
তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগে ২০১৯ সালে প্রশিক্ষণ ও বিমান প্রতিরক্ষা মহড়ার জন্য একটি থাড ব্যাটারি ইসরাইলে পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও রোমানিয়ায় থাড মোতায়েন আছে। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়ায় থাডের একটি ব্যাটারি মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। আর প্রশান্ত মহাসাগরে গুয়াম দ্বীপেও মোতায়েন করা আছে এই শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।