আগে এক সময় খুলনা নগরীর অধিকাংশ বাড়ির আঙিনায় আম, কাঠাল, নারকেলসহ বিভিন্ন প্রকার গাছপালা ছিল। অনেক বাড়িতে পুকুর এবং রাস্তার পাশে জলাশয় ছিল। কিন্তু নগরীতে লোকসংখ্যা বাড়ায় পুকুর ভরাট করে ও গাছপালা কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। নতুন সড়ক তৈরি ও সড়ক প্রশস্ত করার কারণেও গাছপালা কাটার পাশাপাশি জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। এখন আর নগরীতে আগের মতো গাছপালা ও পুকুর নেই। দশতলা কোনো ভবনের ছাদে দাঁড়ালে আগের মতো সবুজ দেখা যায় না, দেখা যায় শুধু ভবন আর ভবন।
প্রায় ৫৩ বছর ধরে নগরীতে বসবাস করা বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান এভাবেই আক্ষেপ করেন। তার এই আক্ষেপের প্রমাণ মেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রুরাল প্লানিং বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণায়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাবে খুলনা নগরীতে উদ্বেগজনকভাবে কমেছে জলাধার ও গাছপালা। ৩০ বছরের ব্যবধানে জলাধার ও গাছপালা কমেছে সাড়ে ৬ বর্গকিলোমিটার এলাকার। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে নগরীতে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রুরাল প্লানিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শিল্পী রায় ও সহযোগী অধ্যাপক তানজিল সওগাত নগরায়ন নিয়ে একটি গবেষণা করেন। ড. শিল্প রায় জানান, তাদের গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে নগরীতে জলাধার কমেছে ৪ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার এলাকার। এছাড়া গাছপালা কমে গেছে ১ দশমিক ৮৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার।
তিনি আরও জানান, নগরীর অধিকাংশ সড়কের পাশে এখন আর আগের মতো গাছপালা নেই। নগরায়নের কারণে আমরা প্রকৃতির খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জলাধার হারিয়েছি। এই হারানোর প্রক্রিয়াটা খুবই উদ্বেগজনক। স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব নগরী করতে গেলে এর ভীষণ রকম ঘাটতি এই শহরে রয়েছে।
খুলনা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে নগরীতে হোল্ডিং ছিল ৩৯ হাজার ৪৩৬টি। ২৪ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৮১টিতে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার জানান, বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি, নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরাতন সড়ক প্রশস্ত করাসহ বিভিন্ন কারণে ভরাট করা হচ্ছে জলাধার, কাটা হচ্ছে গাছ। উদ্বেগজনকভাবে চলছে এই প্রবণতা। গাছপালা যে হারে কাটা হয়েছে, সেই হারে নতুন গাছ লাগানো হয়নি।
এ ব্যাপারে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, খুলনায় অনেক জলাধার ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এসব জলাশয় তাপ শোষণ করে নিতো। আগে অনেক গাছাপালা ছিল, সেগুলো অক্সিজেন সরবরাহ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতো। এখন গাছপালা কমে যাওয়ায় বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে। জলাধার ও গাছপালা কমে যাওয়ায় ক্রমাগত বাড়ছে তাপমাত্রা এবং তীব্র গরমের স্থায়িত্ব। নগরীতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গ্রীষ্মকালে বেশিরভাগ নলকূপে পানি ওঠে না।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মো. আমিরুল আজাদ জানান, চলতি বছরের ২ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিদায়ী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, এ পরিস্থিতির উত্তরণে নদীর তীরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাস্তার দুই পাশে, সড়ক ডিভাইডারে নতুন করে গাছ লাগাতে হবে। সেই গাছগুলো যেন চিরসবুজ গাছ হয়, যেগুলোর পাতা ঝরে না। তাহলে সেই গাছগুলো ছায়া দেবে, অক্সিজেন দেবে এবং তাপ শোষণ করবে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার জানান, জলাধার সংরক্ষণ ও নতুন করে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, খুলনা নগরীর আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।