দেশে চলমান বন্যায় তিন জেলায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা—এই তিন জেলায় ছয় দিন ধরে চলা বন্যায় এ পর্যন্ত ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। এর মধ্যে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিন জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বন্যায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজারের বেশি মানুষ।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট ও ফুলপুর উপজেলায় বন্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল ভোরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। সকাল নয়টা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়। এতে এই তিন উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
হালুয়াঘাট উপজেলার বিলডোরা গ্রামের বাসিন্দা হজরত আলী। বিলডোরা বাজারের কাছেই তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়ির আশপাশে কোমরসমান পানি। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাইর দিন ধইরা পানিত, কেউ আইল না দেখবার। খাইয়া না-খাইয়া বাঁইচ্চা আছি!’
হালুয়াঘাটের ইউএনও এরশাদুল আহমেদ বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন তৎপর রয়েছে। পানিবন্দী মানুষকে শুকনা খাবার ও রান্না করা খাবার বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
ফুলপুরে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে বাক্প্রতিবন্ধী এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন (১৮)। তিনি উপজেলার সিংহেশ্বর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের সেকান্দার আলীর ছেলে।
গত শুক্রবার দুপুরের পর অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় ধোবাউড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। গত সোমবার রাত থেকে পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের পানি কমছে। তবে গতকাল গোয়াতলা, ধোবাউড়া সদরে পানি বাড়ছে। রোববার থেকে ফুলপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়।
নেত্রকোনায়ও গতকাল ভোরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দুর্গাপুর উপজেলায় ঢলের পানিতে ডুবে রুসমত খান (৬২) নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া শেরপুরের ভোগাই-কংসের পানি জারিয়া এলাকায় কংস নদ দিয়ে কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীতে প্রবাহিত হয়। এতে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর—পাঁচটি উপজেলায় বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
শেরপুরে বন্যার উন্নতি
মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কমায় ও বৃষ্টি না হওয়ায় শেরপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে ঝিনাইগাতী ও নকলা উপজেলার অনেক মানুষ এখনো পানিবন্দী।
জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি না হওয়ায় এবং মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কমে যাওয়ায় গতকাল জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার ২০ ইউনিয়নের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে।
জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়ে চারটি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। বন্যার পানি সরে না যাওয়ায় চারটি ইউনিয়নের ৭১টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে উপজেলার গুনাপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে পড়ে জিমি আক্তার (৮) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জিমি আক্তার শেরপুর সদরের কড়ইতলা এলাকার জামান মিয়ার সন্তান। এ নিয়ে নালিতাবাড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেলার পাঁচ উপজেলার কৃষি খাতের ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠছে। গতকাল দুপুরে সরেজমিনে ঝিনাইগাতী উপজেলার পাগলারমুখ বাজার, খৈলকুড়া ও রামেরকুড়া গ্রামে দেখা যায়, এসব গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার আমন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঝিনাইগাতীর খৈলকুড়া গ্রামের বর্গাচাষি আল আমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আড়াই একর জমি বর্গা নিয়ে তিনি আমন আবাদ করেছিলেন। প্রায় ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু পাহাড়ি ঢলে সমস্ত আবাদ নষ্ট হয়ে গেছে।