<

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নপূরণে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন জান্নাতুল ফেরদৌসী

রংপুর শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের গ্রাম দক্ষিণ নবনীদাস। সবুজ গাছগাছালি, ছায়ায় ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ। তিস্তা নদীতীরবর্তী গঙ্গাচড়া উপজেলার এই গ্রামের মুনমুন আক্তারের বাড়ির উঠান। এখানেই ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ে অনেক কথা হবে। তাই জড়ো হয়েছেন আশপাশের নারীরা। তাঁদেরই একজন জান্নাতুল ফেরদৌসী। উপস্থিত নারীদের মধ্যে সবার আগে কুইজের সঠিক উত্তর দিয়ে পুরস্কার হিসেবে স্মার্টফোন জেতেন তিনি। জান্নাতুলের এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে তুমুল করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান অন্যরা। তাঁদের ভাষ্য, যোগ্য নারীর কাছেই গেছে পুরস্কার।

‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো রংপুরেও চলছে ইউনিয়নভিত্তিক উঠান বৈঠক। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে এই আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি।

গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে রংপুরের আট উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ বৈঠক। যা শুরু হয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর গঙ্গাচড়া উপজেলার গঙ্গাচড়া ইউনিয়ন থেকে। বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে কুইজে স্মার্টফোন বিজয়ী জান্নাতুল ফেরদৌসী গৃহিণী। পাশাপাশি তিনি গঙ্গাচড়া ডিগ্রি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। জান্নাতুলের বাড়ি গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ আরাজ মিয়ামঠ গ্রামের বুড়িরহাট এলাকায়। সংসার সামলে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া জান্নাতুল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজ গ্রামে সুপরিচিত।

পুরস্কার জেতার পর কথা হয় জান্নাতুলের সঙ্গে। তিনি জানান, বিয়ের পর নারীরা সংসারের হাল ধরলে তিনি লেখাপড়ায় বিরতি দেননি। স্বামী রোকনুজ্জামান ব্যবসা করেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর শখ ফ্যাশন ডিজাইনার হবেন। সেই লক্ষ্যে তিন বছর আগে স্থানীয় এক কাপড়ের শোরুমে কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এক মাস আগে নিজেই ফেসবুক পেজ চালু করে ব্যবসা শুরু করেন। দোকান থেকে গজ কাপড় কিনে এনে তৈরি করছেন নারী ও শিশুদের জামাকাপড়। পাশাপাশি শাড়িতেও নকশার কাজ করেন। নিজের তৈরি পোশাক সরবরাহ করছেন বিভিন্ন দোকানে ও শোরুমে। টুকটাক অর্ডার পাচ্ছেন অনলাইনেও। কখনো নিজে আবার কখনো তাঁর স্বামী গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন।

উঠান বৈঠকের খোঁজ কীভাবে পেলেন তিনি? জান্নাতুল বলেন, ‘প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার আশরাফুল ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম, আমাদের গ্রামে একটি উঠান বৈঠক হবে। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে নারীদের শেখানো হবে, জানা যাবে অনেক কিছু। তাই সকাল সকাল চলে আসি। কুইজে অংশ নিয়ে পুরস্কারও জিতেছি।’ পুরস্কারপ্রাপ্তির আনন্দ জান্নাতুলের কণ্ঠে, ‘কল্পনাও করতে পারিনি আমি স্মার্টফোন পুরস্কার পাব। এই স্মার্টফোন আমাকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন আরও বাড়িয়ে দিল। আমাকে স্বপ্নপূরণে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল।’

উঠান বৈঠকে স্বাস্থ্য বিষয়ে এক কুইজের প্রশ্নে সবার আগে সঠিক উত্তর দিয়ে পুরস্কার জিতে নেন পলি খাতুন নামের একজন অংশগ্রহণকারী। তিনি বলেন, ‘হামরা মোবাইল ফোনোত খালি গান শুনি। কিন্তু অ্যাটে আসিয়া অনেক কিছু জানবার পাইনো। কেমন করিয়া রান্নাবান্না করা যায়, ব্যবসাও করা যায়।’

একই দিনের বিকেল। গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্নেয়া ইউনিয়নের মৌভাষা গ্রামের পারুল বেগমের উঠানে অনুষ্ঠিত হয় আরেকটি বৈঠক। এলাকার উচ্ছ্বসিত নারীদের উপস্থিতিতে এটি সঞ্চালনা করেন স্থানীয় বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক সংগীতা দাস। স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নানা ধরনের তথ্য ও ভিডিও উপস্থিতি নারীদের দেখান তিনি।

উঠান বৈঠকে আসা মারুফা ইয়াসমিন নামের এক গৃহিণী বলেন, ‘ছাওয়াগুলা খালি গেম গেলায়, নাচ-গান দেখে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানোত আসিয়া অনেক আজানা জিনিস জানবার পাইনো। ঘরোত বসিয়া এই মোবাইল দিয়া অনেক টাকা রোজগার করা যায়। শাড়ি, কাপড়োত নকশা করার কাজ শেখা যায়। কেমন করিয়া চিকিৎসা পাওয়া যায়, তা–ও শেখা হইল।’

‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। গত রোববার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের ১ হাজার ২২১টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।