ফাতেমা, ইব্রাহীম ও আবু বকরদের রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে আসতে হয় স্কুলে। স্বস্তি নেই সেখানেও। স্কুলটির নিজস্ব কোনো ভবন না থাকায় খোলা আকাশের নিচে ও একটি টিনশেডের নিচে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। এক মাসের বেশি সময় আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পদ্মার বুকে বিলীন হয়েছে।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতিদিন স্কুলে যাচ্ছে। থেমে নেই শিক্ষকেরাও। তাঁরা নাওডোবা এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি ফাঁকা জায়গায় পাঠদান কার্যক্রম চালু রেখেছেন।
স্কুলটির সূত্রে জানা যায়, ১৯৭০ সালে জাজিরার পদ্মাতীরবর্তী নাওডোবা পাইনপাড়া এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন পাইনপাড়া এলাকাটি পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে ছিল। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় নদীভাঙনের কবলে পড়ে এলাকাটি এখন পদ্মা নদীর মাঝামাঝি স্থানে একটি চরে রূপান্তরিত হয়েছে।
পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রথমবার ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৯৫ সালে। দ্বিতীয় দফায় ২০০৭ সালে ভাঙনের কারণে এটির জমি ও অবকাঠামো নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর ২০১৩ সালে চরপাইনপাড়ায় ৩৩ শতাংশ জমির ওপর ৫টি কক্ষ নির্মাণ করে বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।
গত বর্ষায় নদীভাঙনের কবলে পড়ে প্রথমে বিদ্যালয়ের মাঠটি বিলীন হয়। এরপর ৫ অক্টোবর বিদ্যালয়টির টিনশেড ঘর ভাঙনের কবলে পড়লে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই সময় নদীর দক্ষিণ তীরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের একটি খালি জমিতে বিদ্যালয়ের জিনিস ও আসবাবপত্র স্তূপ করে রাখা হয়। ওই সময় টানা ১০ দিন বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল।
বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পদ্মা নদীর মাঝে অবস্থিত চরপাইনপাড়া এলাকার। এখন সেটি অস্থায়ীভাবে চালু হয়েছে নদীর দক্ষিণ তীরের নাওডোবা এলাকায়। এ কারণে নৌকায় করে পদ্মার প্রায় দুই কিলোমিটার জলপথ পাড়ি দিয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে আসতে হচ্ছে। নদী পারাপারের ভয়ে প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না অভিভাবকেরা।
গতকাল বুধবার পদ্মা সেতু প্রকল্পের নাওডোবা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা একটি খালি জমিতে ভাঙনের শিকার কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে একটি মাদ্রাসার রান্নাঘরের বারান্দা ও খোলা আকাশের নিচে। রোদের মধ্যে বসেই পড়ালেখা করছে শিশুরা। পাশে একটি নলকূপ থাকলেও কোনো টয়লেট নেই। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৪০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠ কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির হলেও সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে রেখে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন শিক্ষকেরা।
সুমনা ও মেহেদী হাসান নামের বিদ্যালয়টির তৃতীয় শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী জানায়, তারা সাঁতার জানে, তবু নদী পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে ভয় লাগে। প্রতিদিন সকালে পদ্মা পাড়ি দিয়ে নাওডোয় গিয়ে আবার বিকেলে গ্রামে ফিরে যায় তারা।
পঞ্চম শ্রেণির নিশাতুল রায়হানা ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু রায়হানের বসতবাড়ি পদ্মায় বিলীন হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। এরপর চোখের সামনে বিদ্যালয়টির একই পরিণতি দেখেছে তারা। সেই কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে এই দুই শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়টির অবকাঠামো না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে বেগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলে, ‘বিদ্যালয়টি নেই, ভাবতে পারছি না। সামনে শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই বিবেচনায় খোলা আকাশের নিচে শ্রেণির কার্যক্রম চালাচ্ছি। স্কুলটা কোথায় নিয়ে চালু করা হবে, কে আমাদের জমি দেবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তাদের স্কুলটির অবস্থা জানিয়েছি। তাঁরা আসেননি আর এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও দিতে পারেননি।’
বিদ্যালয়টি পরিদর্শন না করার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন জাজিরা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়ামত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, একটি স্কুল নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। সেটি দেখতে যেতে পারিনি। স্কুলটির শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ কি না, তা–ও বলতে পারব না।’
সার্বিক বিষয়ে জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, ‘আমি জাজিরায় যোগদান করেছি দুই সপ্তাহ হলো। কোনো স্কুল নদীতে বিলীন হয়েছে, তা কেউ আমাকে জানাননি। খোঁজ নিয়ে দেখব বিদ্যালয়টির বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়।’