<

নভেম্বরেও ডেঙ্গু সংক্রমণে উচ্চ হার

  • ১ থেকে ৭ নভেম্বর ডেঙ্গুতে ৩৭ জনের মৃত্যু, সংক্রমণ ৭,২৫৭ 
  • ১ থেকে ৭ অক্টোবর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ২২, সংক্রমণ ৫,৭২৬
  • অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে মৃত্যু ২৮, সংক্রমণ ৭,১১৫

অক্টোবর মাসটা আবু হাসানের (ছদ্মনাম) কেটেছে ডেঙ্গু রোগী নিয়ে। তিনি থাকেন রাজধানীর ভাষানটেকের দ্বীন মোহাম্মদ কলোনিতে। তাঁর বোন, বড় শ্যালিকা এবং বাড়ির গৃহকর্মী—এক মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজনকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়েছিল।

আবু হাসান বলছিলেন, ‘রোগী আর হাসপাতাল—এ নিয়ে ছোটাছুটিতে গেছে পুরো মাস। সময়, অর্থ, ভীতি—সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ সময়। বাসার শিশুদের নিয়ে ছিল বড় ভয়।’

নিজের এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন আবু হাসান। ডেঙ্গু কিন্তু এই নভেম্বর মাসেও কমছে না। চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে দেশে ডেঙ্গুতে যত মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে, তা বছরের কোনো সপ্তাহেই হয়নি।

নভেম্বরে সাধারণত এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম। এ ব্যতিক্রম শঙ্কা জাগাচ্ছে জনস্বাস্থ্যবিদদের।

জনস্বাস্থ্যবিদ, চিকিৎসক ও কীটতত্ত্ববিদদের কথা, ডেঙ্গুর বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আবার চিকিৎসাব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হয়নি। 

চলতি নভেম্বর মাসের ১ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২৫৭ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত মাসের হিসাবে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে গত অক্টোবর মাসে। ওই মাসের প্রথম সাত দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২ ও ৫ হাজার ৭২৬। অক্টোবরের শেষ সাত দিনে (২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ১১৫। আর মৃত্যু হয়েছিল ২৮ জনের।

আর গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৬ জন। 

২০২২ সালের ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং এতে মৃত্যু কমে আসে। ওই বছর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবর মাসে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল নভেম্বরে। কিন্তু নভেম্বরে সংক্রমণ কমে গিয়েছিল আগের মাসের তুলনায়। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম হলো।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বরে সংক্রমণ আগে কখনোই এভাবে বাড়েনি। এখন দেশে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরও অন্তত ১৫ দিন চলতে পারে। আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে মৃত্যুর আরও ঘটনা ঘটতে পারে। 

অতীত গতিপথ মানছে না ডেঙ্গু

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি যেকোনো বছরে এ রোগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। দেশের ইতিহাসে গত বছর সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

সংক্রামক রোগের বিস্তৃতি অনুসরণ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে মাসিক ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর’ বা বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা। এর মাধ্যমে জানা যায়, আগের মাসের তুলনায় বর্তমান মাসে বা বর্তমান মাসের তুলনায় পরবর্তী মাসে কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে বা মারা যাবে।

যুক্তরাজ্যের কিল ইউনিভার্সিটির গবেষক নাজমুল হায়দার বাংলাদেশের গত ২৩ বছরের ডেঙ্গুর বিস্তারের ওপর ভিত্তি করে মাসিক বৃদ্ধির হার নির্ণয় করেছেন। এ–সংক্রান্ত গবেষণা জার্নাল অব মেডিকেল এন্টোমোলজি নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে জুন মাসে ডেঙ্গু বৃদ্ধির হার থাকে সর্বোচ্চ—২ দশমিক ৪২। অর্থাৎ জুন মাসের সংক্রমণের হার জুলাইয়ে গিয়ে প্রায় আড়াই গুণ বাড়তে পারে। অক্টোবর মাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্তের অর্ধেক। সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৮২ থেকে অক্টোবরে কমে আসে শূন্য দশমিক ৪৫–এ।

গত ২৩ বছরের উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৪৫ থেকে শূন্য দশমিক ৫৩। এ হিসাবে নভেম্বর মাসেও শতাধিক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।

এ গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অস্বাভাবিক বৃষ্টি এবং মশা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনা করা হয়নি। তাই বৃদ্ধির হার যেভাবে দেখা হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম।

তবে গবেষক নাজমুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, রোগ বৃদ্ধির হার সব বছর মিলবে না। বিস্ময়কর বিষয় হলো, বাংলাদেশে সংক্রমণ বৃদ্ধির হারের সর্বোচ্চ সংখ্যাও অতিক্রম করে গেছে। যেমন এ বছরের আগস্ট মাসের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাকে (৬ হাজার ৫২১) বিবেচনায় নিলে সেপ্টেম্বর মাসের সর্বোচ্চ রোগী হওয়ার কথা ছিল ৮ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু বাস্তবে সেপ্টেম্বর মাসে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৮ হাজারের বেশি। এটা ধারণার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। ডেঙ্গু বহু কারণে ঘটা একটি সংক্রামক রোগ। যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, পরিবেশে মশার সংখ্যা, মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা ইত্যাদির কারণে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে।