<

ভোলায় সারের বেশি দামে নাকাল কৃষক

ভোলা জেলা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার এবং দৌলতখান উপজেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মাঝখানে জেগে উঠেছে এক চর। নাম তার মাঝের চর। এই চরের প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে ধানসহ নানা ফসল আবাদ করা হয়। অথচ এখানে কোনো সারের ডিলার নেই। নেই বিক্রয় কেন্দ্র। এতে কৃষকদের বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। অন্য এলাকায় গিয়ে আনতে গিয়ে সার পরিবহনে খরচ বেশি পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে এই চরের কৃষকেরা চরে সরকারিভাবে সার বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝেরচর দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ও মেদুয়া ইউনিয়ন এবং সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের একটি অংশ নিয়ে গঠিত। মাঝের চরের জমিতে রবিমৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে উন্নত মানের সবজি, তেল, ডাল ও ধানের আবাদ হচ্ছে। এই চরের প্রায় ৫ হাজার কৃষককে চাষাবাদের জন্য ভোলা অথবা লক্ষ্মীপুর শহর থেকে অতিরিক্ত মূল্যে সার কিনতে হচ্ছে। আর যাঁরা ২-১ কেজি সার কেনেন, তাঁরা মদনপুর থেকে সংগ্রহ করেন। বস্তা কিনলেও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।

মাঝের চরের কয়েকজন কৃষক বলেন, মদনপুর ইউনিয়নের বিএডিসির সার ডিলারের জন্য বরাদ্দ করা ভর্তুকির সার সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে তুলে নিচ্ছেন। তাঁদের হাত থেকে সেই সার চলে যাচ্ছে অননুমোদিত খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। এর ফলে ভর্তুকির সার মদনপুরের কৃষকদের বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ে কোনো তদারকি নেই বলে কৃষকেরা অভিযোগ করেছেন।

সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণসংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯–এ বলা হয়েছে, ডিলারদের অনুকূলে বরাদ্দ করা সার, ডিলার নিজে উত্তোলন করবেন অথবা তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্য থেকে একজনকে সার তোলার ক্ষমতা দেবেন। ডিলার মনোনীত প্রতিনিধির ছবি প্রত্যয়ন করে লিখিতভাবে সার তোলার ক্ষমতা দেবেন; কিন্তু মদনপুরের সার ডিলার এই নীতিমালা মানছেন না।

কয়েকজন উপসকারী কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মৌসুমে মাঝের চরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন সার দরকার। তবে কৃষকেরা বলছেন, কৃষি কর্মকর্তার হিসাবের চেয়ে তাঁদের সার আরও বেশি দরকার। কারণ, রবি মৌসুমে তাঁরা একই জমিতে উন্নত জাতের কয়েকটি ফসলের আবাদ করছেন। যেমন ক্যাপসিকাম, তরমুজ, কাঁচা মরিচ, করল্লা, চিচিঙ্গা ও শসা। এসব সবজি দেশের বাইরে যাচ্ছে। মূল ভূখণ্ডে তিনটি(খরিফ-১, ২ ও রবি) মৌসুম হলেও তাঁরা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত একটি মৌসুম ধরে মাঝের চরে একাধিক ফসল আবাদ করছেন। পরে তাঁরা খেতে আমন ধান আবাদ করেন। এ কারণে তাঁদের সার বেশি দরকার হয়।

মদনপুর ইউনিয়ন, চর কাচিয়া ও চর নেয়ামতপুরের একাধিক কৃষক ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, মদনপুর ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার একর, চর কাচিয়ার অংশে ৫০০ একর এবং চর নেয়ামতপুরে প্রায় দেড় হাজার একর জমিতে ১২ মাস কমবেশি সবজি ও আমন ধান আবাদ হচ্ছে; কিন্তু এখানে কোনো সারের ন্যায্যমূল্যের বা ডিলারের দোকান নেই। মুদিদোকানদার ২-৪ বস্তা সার কিনে এনে বেশি দামে খুচরা বিক্রি করেন। যেসব কৃষকের বেশি সার দরকার, তাঁরা ভোলা শহর ও ভোলার বাইরে থেকে সার সংগ্রহ করছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মদনপুরে কমপক্ষে ১০টি মুদিদোকানে খুচরায় সার বিক্রি হচ্ছে। এসব দোকানে সারের মূল্য তালিকা নেই। তাঁরা ৩০ টাকার নিচে কোনো সার বিক্রি করছে না। সরেজমিন এ ইউনিয়নে কোনো সারের ডিলারের গুদাম বা বিক্রয়কেন্দ্র চোখে পড়েনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের সরকারের নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য ২৭ টাকা, টিএসপির (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা ও এমওপির কেজি ২০ টাকা; কিন্তু মদনপুর ইউনিয়নে ৩০-৪০ টাকার নিচে কোনো সার পাওয়া যায় না।

চরপদ্মা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌকিদার বলেন, তিনি সোমবার (গত ২৮অক্টোবর) পাটওয়ারীবাজার থেকে কালা সার (টিএসপি) ৪০ টাকা, ডিএপি ৩০ টাকা, চিকন সাদা সার (ইউরিয়া) ৪০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন। এর কমে মদনপুরে কোনো সার নেই।

কৃষকেরা আরও জানান, তাঁরা ভোলার সারের বাজারে যে কালো সারের (টিএসপি/ডিএপি) ৫০ কেজির বস্তা ১ হাজার ৩৩০ টাকা, সেই একই সারের বস্তা মদনপুরে ১ হাজার ৪৫০-১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর লাল সারের (এমওপি) যে বস্তা ভোলার বাজারে ১ হাজার ৭০ টাকা, সে বস্তা মদনপুরে ১ হাজার ২৭০ টাকা ও ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মদনপুরের কৃষক নিজাম ফরাজি, কাচিয়া মাঝের চর অংশের ৩ নম্বর প্রকল্পের কৃষক মো ইউসুফ মিজি, নেয়ামতপুরের কৃষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এক একর জমিতে সবজি আবাদ করতে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও জৈবসারসহ প্রায় এক টন সার দরকার। এখন সব সারই তাঁদের ভোলা সদর উপজেলার বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এক বস্তা সার কিনে মাঝের চরে আনতে তাঁদের ১২০ থেকে ১৩৫ টাকা খরচ হয়। ওই সার চরের খুচরা দোকান থেকে কিনতে বস্তা হিসাবে কিনলে আরও ১০০ টাকা বেশি লাগে। আর কেজি হিসাবে কিনলে কেজিতে ৮-১০ টাকা বেশি নেয়। এ কারণে তাঁরা কয়েকজন কৃষক মিলে নৌকা ভাড়া করে ভোলা সদর থেকে সার কিনে আনেন।

মদনপুরের আরেক কৃষক ও ইউপি সদস্য মো. ফারুক দৌলত বলেন, গত ২৫ অক্টোবর তিনি ২ হাজার টাকায় এক বস্তা ইউরিয়া কিনে আমন খেতে ছিটিয়েছেন।

ফারুক দৌলত আরও জানান, মদনপুর ইউনিয়নের যিনি সার ডিলার, ইউনিয়নের কোনো স্থানে তাঁর বিক্রয়কেন্দ্র কিংবা গুদাম নেই। তিনি মদনপুরের বাসিন্দাও নন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মদনপুরের সারের ডিলার মো. হুমায়ুন কবীর মোল্লা বলেন, মদনপুরে তাঁর বিক্রয় প্রতিনিধি হচ্ছে আবুল হাসেম। তিনি তাঁর কাছ থেকে সার কিনে নিয়ে বিক্রি করেন; কিন্তু আবুল হাসেম জানান, তিনি ভোলা শহর থেকে সার কেনেন।

মদনপুরের পাটওয়ারীবাজারের দোকানদার মো. বনিয়ামিন জানান, তিনি ভোলা শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে সার কিনে মদনপুরে এনে বিক্রি করেন। এসব সারের দোকানদার কোনো পাকা রসিদ দেন না। তিনি ২৮ অক্টোবর মোটা দানার ইউরিয়ার (৫০ কেজি) বস্তা কিনেছেন ১ হাজার ৩২০ টাকায়, চিকন দানার বস্তা কিনেছেন ১ হাজার ৬০০ টাকায়, বিএডিসির ড্যাপের বস্তা কিনেছেন ১ হাজার ৩০ টাকায়, কালচে ড্যাপের বস্তা কিনেছেন ১ হাজার ৭০০ টাকায়, তিউনিসিয়া ও চায়নার কালো সার (টিএসপি) কিনেছেন ১ হাজার ৫৫০ টাকায়, টিএসপির বস্তা কিনেছেন ১ হাজার ৩৩০ টাকায়। এক বস্তা সার পাটওয়ারী বাজারের পৌঁছাতে ১১০ টাকা খরচ হয়।

দৌলতখান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়রা সিদ্দীকা বলেন, মদনপুর ইউনিয়নের সারের ডিলার হুমায়ুন কবির মোল্লা। তাঁর বিক্রয়কেন্দ্রের নাম মেসার্স ভোলা কৃষি কেমিক্যালস। যেটি মদনপুর ইউনিয়ন থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাংলাবাজারে। ডিলারের নামে বরাদ্দ করা সার মদনপুরের কৃষকের কোনো উপকারে লাগছে না বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা কৃষি কার্যালয় থেকে তাঁকে বারবার লিখিতভাবে সতর্ক করা হলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে বাংলাবাজারেই ব্যবসা করছেন।

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ)এএফএম শাহাবুদ্দিন বলেন, যিনি ইউনিয়নের ডিলার হবেন তাঁর ইউনিয়নে অবশ্যই গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে তিনি আঞ্চলিক পরিচালকের সঙ্গে ও জেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সঙ্গে কথা বলবেন। যাতে ডিলার ইউনিয়নে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে।

ভোলা জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ভোলা জেলা প্রশাসক আজাদ জাহান বলেন, মদনপুরে ইউনিয়নে নিয়োগ দেওয়ার সার ডিলার যাতে ওই ইউনিয়নে (মাঝের চরে) গিয়ে সার বিক্রি করেন সে ব্যাপারে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।