<

ক্ষুদ্রচেষ্টায় হারিয়ে যাওয়া সময়ের খোঁজে

হেমন্তের বিকেল তখন সন্ধ্যার কাছে যেতে শুরু করেছে। ফুটপাত থেকে রাস্তা, চারপাশ লোকে লোকারণ্য। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর, সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়, লম্বা হতে থাকে রিকশার সারি। একে ছুটির দিন, সঙ্গে শ্যামাপূজার মেলা আর মুক্তমঞ্চে যাত্রা উৎসব—শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিল উপচে পড়া ভিড়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় গত শুক্রবার শুরু হয়েছে সাত দিনের এই যাত্রা উৎসব। রমনা কালীমন্দিরের গেট দিয়ে ঢুকতে বেগ পেতে হলো বেশ। সেখান থেকে মুক্তমঞ্চে যেতে হাঁটতে হলোই না প্রায়, মানুষের মিছিলই পৌঁছে দিল।

অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনো আধঘণ্টা বাকি; অথচ তিলধারণের জায়গা নেই। বাদক দলের ঢোল, ঢাক, বাঁশি, সানাই, খঞ্জনি ও ঝুনঝুনির শব্দে মঞ্চে তখন তৈরি হয়েছে যাত্রার আবহ। পাশেই বসে সংলাপের খাতা থেকে আওড়াচ্ছিলেন প্রম্পটার। ব্যাক স্টেজ থেকে মঞ্চে পায়চারি করছিলেন যাত্রাদলের সদস্যরা।

এতকিছুর মধ্যে একজন মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ল। তিনি আয়োজক প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমির প্রধান, অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। মঞ্চ আর আশপাশের বিভিন্ন বিষয় তদারক করছিলেন। বারবার ঘড়ি দেখছিলেন, সময়মতো সব শুরু করার তাড়া দিচ্ছিলেন। সাউন্ড থেকে আলোকসজ্জা—সবকিছু দেখভাল করার ফাঁকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গেও আলাপ সেরে নিচ্ছিলেন। হেমন্তের হিমহিম আবহের মধে৵ও ঘামছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী, শ্রমিক থেকে হকার—সব পেশার মানুষকেই দেখা গেল। বেশির ভাগই তরুণ, যাঁদের অনেকে যাত্রার সোনালি সময়ের গল্পই কেবল শুনেছেন। তেমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত আহমেদ। তাঁর পরিকল্পনাতেই এক হয়ে যাত্রা দেখতে এসেছেন বন্ধুরা। রুবাইয়াত জানান, ‘বাবার কাছে শুনেছি, এলাকায় যাত্রার দল এলে পালা দেখার জন্য বাবা কাছারি থেকে রাতে লুকিয়ে জানালা দিয়ে নেমে চলে যেতেন। দরজা ভেতর থেকে ঠিকই বন্ধ থাকত, ফলে দাদা বুঝতে পারতেন না। “সোহরাব রুস্তম”, “নবাব সিরাজউদ্দৌলা”, “গুনাই বিবির পালা”, “রূপবান”, বেহুলা লখিন্দর” যাত্রাপালার গল্প শুনে কেটেছে আমার শৈশব। সামনে থেকে দেখার সুযোগ এলে মিস করতে চাইনি। বাবাকে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা জানাব।’

বয়সে জ্যেষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গেও কথা হলো। তাঁদেরই একজন পানি বিক্রেতা লাল মিয়া ফকির। কৈশোরে যাত্রার মাইকিং এখনো তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। সুরে সুরে বলে গেলেন ‘সারা দিন মাইকিং হইত…যাত্রা, যাত্রা, যাত্রা। ভাইসব, ভাইসব, আইজ রাত ১১টায় নারান্দী গ্রামের শিঙা নদীর পাড়ে যাত্রাপালা “সোহরাব–রুস্তম”। ঝুমুর ঝুমুর নাচে মঞ্চ কাঁপাবেন প্রিন্সেস ডলি, প্রিন্সেস মল্লিকা ও প্রিন্সেস রোজি। সঙ্গে থাকবে একঝাঁক ডানাকাটা পরী। এই সুযোগ হেলায় হারাবেন না। ভাইসব, ভাইসব…ঘর থাইকা লুকাইয়া শীতের রাইতে নদীর পাড়ে হাজির হইতাম। ওপরে বড় শামিয়ানা টানাইয়া বাঁশের মাচা বানায় তার ওপর তক্তা বিছাইয়া স্টেজ বানাইতো। কই গেলো হেদিন।’

লাল মিয়া ফকিরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুরু হয়ে গেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উৎসবের উদ্বোধন করেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রিকশাচালক ইসরাফিল মজুমদার। এ পর্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন যাত্রাশিল্পী অনিমা দে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ফয়েজ জহির।

সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক জামিল আহমেদ। বক্তব্য দিলেন সামান্যই, ‘শিল্পচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এবং গ্রামীণ জনসাধারণের বিনোদনের ঐতিহ্য বিবেচনায় আমরা এই যাত্রাপালার আয়োজন করেছি।’ রিকশাচালক ইসরাফিল মজুমদারের অনুরোধ, ‘বাংলাদেশের সরকার পরিচালনায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন দেশকে ভালোবাসে।’ দর্শকসারিতে ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী শিলা আহমেদ।
এর পরই আসে পালা শুরুর ঘোষণা, ‘হা ভাই, এখনই শুরু হবে সুরুভী অপেরার

পরিবেশনা ‘নিহত গোলাপ…’।’ চারদিকের কোলাহল কমে যায়। দলীয় পরিবেশনায় দেশাত্মবোধক গান ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’-এর মাধ্যমে শুরু হয় কবির খানের পালা ‘নিহত গোলাপ’।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নিউ শামীম নাট্য সংস্থার ‘আনারকলি’। আজ রোববার থাকবে বঙ্গবাণী অপেরার ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এ ছাড়া আগামীকাল সোমবার নরনারায়ণ অপেরার ‘লালন ফকির’, পরশু মঙ্গলবার বন্ধু অপেরার ‘আপন দুলাল’, বুধবার শারমিন অপেরার ‘ফুলন দেবী’ এবং বৃহস্পতিবার সমাপনী সন্ধ্যায় থাকবে যাত্রাবন্ধু অপেরার ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’।