বেলা তখন তিনটা। সড়কের পাশে ছোট্ট এক টংদোকান ঘিরে গাছগাছালি ও বৈদ্যুতিক তারে শত শত পাখির কিচিরমিচির। একটু পরেই এলেন এক বৃদ্ধ। তাঁকে দেখে পাখিদের কলরব আরও বেড়ে গেল। বৃদ্ধ খাবার ছিটিয়ে দিলেন, পাখিগুলো কিচিরমিচির থামিয়ে খেতে থাকল সেই খাবার।
ঘটনাটি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামের বাজারের। ওই বৃদ্ধের নাম নুরুল ইসলাম (৬৭)। তিনি পাশের গ্রাম কবিরের বাজারের বাসিন্দা। ইকুরিয়া বাজারে চানাচুর, নিমকি, বিস্কুটসহ নানা জিনিসের দোকান তাঁর। এখানে তাঁর ৪০ বছরের ব্যবসা। আর পাখিদের খাবার দিচ্ছেন
গতকাল শুক্রবার নুরুলের দোকানের আশপাশে খাবার খেতে এসেছিল বুলবুলি, ভাতশালিক, ঝুঁটিশালিক, কাঠশালিক, ঘুঘু, গোশালিক, বকসহ নানা জাতের দেশি পাখি। কেন খাবার দেন—এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অহন তো পাখপাখালির খাওনা নাই। এরা খায় কী। দয়া লাগে, তাই দেই। এতে আমার সৃষ্টিকর্তাও খুশি হয়। খাবার দিয়া আমি যে আনন্দ পাই, তা আপনি বুঝবেন না। খাওয়া দেওয়ার অভ্যাস করছি। অহন এরা আসে। এদের তো আমি বিমুখ করতে পারি না। আমি গরিব মানুষ হলেও এই সামান্য আয়ের কিছু অংশ পখিগুলোর জন্য রাইখা দেই। আমি তৃপ্তি পাই।’
আলাপে আলাপে নুরুল ইসলাম বলেন, ৪০ বছর আগে ইকুরিয়া বাজারের পাশে স্লুইসগেট–সংলগ্ন এলাকায় তিনি কসমেটিকসের দোকান শুরু করেন। একদিন দোকানের সামনে কিছু শালিক পাখি আসে। তিনি তাঁর কাছে থাকা কিছু মুড়ি ছিটিয়ে দেন। পাখিরা সেগুলো খায়। পরের দিন থেকে পাখিরা তাঁর দোকানের সামনে আসতে থাকে। তিনিও তাদের খাবার দেওয়া অব্যাহত রাখেন। এভাবে দিনে দিনে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন ২০০ থেকে ৩০০ পাখি আসে বলে তাঁর দাবি। স্বল্প আয়ের মানুষ হলেও তিনি এই পাখিদের খাবার দেওয়া বন্ধ করেননি। তবে কখনো অসুস্থ হয়ে দোকান খুলতে না পারলে পাখিদের খাবার দেওয়া হয় না। তখন পাখিগুলোর জন্য তাঁর মন খারাপ হয়।
বাজারের আশপাশের কয়েকজন দোকানি বলেন, নুরুল ইসলাম শুধু পাখিদের নয়, রাস্তাঘাটের মানসিক রোগী, অসুস্থ কুকুর-বিড়ালকেও খাবার দেন। পাখিদের পাশাপাশি নিয়মিত তাঁর দোকানের সামনে এসে কিছু কুকুর-বিড়ালও খাবার খায়।
বাজারের চা–দোকানি আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল ইসলামের এই অভ্যাস বহুদিনের। পাখিগুলো তাঁর বন্ধু হয়ে গেছে। সময়মতো সব চলে আসে। শুরুতে তাঁর এ কাজকে অনেকে পাগলামি বললেও এখন সবার কাছে এই দৃশ্য পরিচিত হয়ে গেছে। এলাকার সবাই তাঁকে প্রাণিপ্রেমী হিসেবে চেনে।
স্থানীয় বাসিন্দা দীপক বর্মণ বলেন, ‘প্রাণীদের জন্য নুরুলের মায়ার ব্যাপারটা অন্য রকম। প্রতিদিন তিনি কিছু চাল, মুড়ি, চানাচুর, নিমকি কিংবা ধান খাবার হিসেবে পাখিকে দেন। এটা দেখে আমাদের শেখার আছে।’
গ্রামটি কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নে পড়েছে। এই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম বহু বছর ধরে কাজটি করে যাচ্ছেন। ভেতরে মানবতাবোধ থাকলেই কেবল একজন মানুষ পশুপাখির প্রতি দয়া দেখাতে পারেন। তিনি গরিব হতে পারে, কিন্তু তাঁর ভেতরে মানবতাবোধ আছে। এটা খুবই পুণ্যের কাজ।’