মেক আমেরিকা, গ্রেট এগেইন অর্থাৎ আবার আমেরিকাকে মহান করে তুলুন! রাজনীতি নিয়ে যাদের অন্তত সামান্য বোঝাপড়া আছে, সবাই জানেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার স্লোগান এটি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে নেমেছিলেন এই স্লোগান নিয়ে। রিপাবলিকান দলের এই প্রার্থী চব্বিশের ভোটেও এই বুলি আওড়াচ্ছেন। মার্কিনদের বলছেন, আই এম ইউর ভয়েস। আমেরিকা ফার্স্ট। স্লোগানকে ছাপিয়ে গেছে যে প্রশ্ন তা হলো— এগেইন ট্রাম্প? মানে ট্রাম্প কি আবারও ক্ষমতায় আসছেন?
ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালার মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে জরিপে। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের ২০–২৩ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত জাতীয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, কমালা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প দুইজনই ৪৮ শতাংশ সমর্থন নিয়ে সমান অবস্থানে রয়েছেন। বাকি ৪ শতাংশ ভোটার এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
গত রোববার (২৭ অক্টোবর) প্রকাশিত এবিসি নিউজের সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে জাতীয় জরিপে কমালা হ্যারিস ট্রাম্পের চেয়ে ২ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। যদিও ফলাফল নির্ধারণে বড় ফ্যাক্টর ইলেক্টোরাল ভোট, সে কথা সবার জানা।
অথচ বছর দেড়-দুয়েক মধ্যে কেউ কি অবচেতন মনে ভেবেছিল, ট্রাম্প আবার নেতৃত্ব দেবেন আমেরিকার? যে কি না অভিসংশিত হওয়া তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট, দুইবার অভিসংশিত হওয়া একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর তার পক্ষে বাজি ধরার লোক নিশ্চয়ই খুবই কম ছিল। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টেছে। সেক্ষেত্রে তাকে সুবিধাজনক অবস্থানে আসতে সহায়তা করেছে জো বাইডেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাকে নিয়ে কম বিতর্ক চলেনি। চব্বিশের ভোটে তার ওপরই আবারও ভরসা রাখে ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু গত ২৭ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম প্রেসিডেন্ট বিতর্কে ধরাশায়ী হন জো বাইডেন। ট্রাম্পের সমর্থন তুঙ্গে ওঠে। পিছিয়ে পড়ে জো বাইডেন ২২ জুলাই সরে দাঁড়ান। আর বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। ভোটের লড়াইয়ে শামিল হয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরকে উজ্জীবিত করেছেন কমালা হ্যারিস। এই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার কখনও ট্রাম্প এগোচ্ছেন। কখনও আবার সমানে সমান।
আর ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউজে গেলে কেবল দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবেন তা নয়, সে-ও মার্কিন রাজনীতিতে লিখবেন নতুন ইতিহাস! অন্তত পাঁচবার দল পাল্টে শেষপর্যন্ত রিপাবলিকান থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্পের বেলায় তা হয়তো অসম্ভব না।
১৯৪৬ সালের ১৪ জুন জন্ম ট্রাম্পের। তার বাবা-মা জার্মান ও স্কটিশ বংশোদ্ভুত আমেরিকান। বাবা ফ্রেড ট্রাম্প ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিল্ডার ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী।
শৈশবে ট্রাম্প বেশ দুষ্টু ছিলেন। তাই শৃঙ্খলা শেখাতে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তাকে সামরিক একাডেমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নিউইয়র্ক মিলিটারি একাডেমি থেকে হাইস্কুল শেষ করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই বছরের জন্য ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তারপর তিনি পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজাত হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলে চলে যান, সেখান থেকে তিনি ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরমধ্যে বাবার কোম্পানিতে যোগ দেন ট্রাম্প। তবে এর আগে তিনি বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাবার হাত থেকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন এবং নতুন নাম রাখেন ট্রাম্প অর্গানাইজেশন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে বরাবরই বিতর্ক থেকে গেছে। বিয়ে করেছেন তিনটি। প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভানা জেলনিকোভা। যিনি একজন চেক ক্রীড়াবিদ, মডেল ও ব্যবসায়ী। তাদের তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। ইভানা জেলনিকোভার সঙ্গে ট্রাম্প ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সংসার করেন। ট্রাম্পের যৌন অবিশ্বস্ততার গুজবের মধ্যেই তাদের সম্পর্কের ইতি হয়েছিল।
১৯৯৩ সালে অভিনেত্রী মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। বেশিদিন টিকেনি এই সংসার। তাদের বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৯ সালে। এই দম্পতির ঘরে একটি কন্যা হয়েছিল— টিফানি ট্রাম্প। এরপর ২০০৫ সালে স্লোভেনিয়ান মডেল মেলানিয়া নাউসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প, যিনি তার বর্তমান স্ত্রী। তার সঙ্গে ট্রাম্পের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে— ব্যারন ট্রাম্প।
এছাড়া, একাধিকবার যৌন নির্যাতন ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গোপন রাখতে তাকে ২০০৬ সালে মোটা অঙ্কের ঘুষ দেন ট্রাম্প। ওই খরচের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতির অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় ৩৪টি গুরুতর অপরাধে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যাকে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
৩৪ বছর বয়সে ট্রাম্প রাজনীতিকে খুবই নিচুস্তরের জীবন হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। আর সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিরা রাজনীতির পরিবর্তে ব্যবসার জগতকে বেছে নেন বলে মত দিয়েছিলেন। তবে কয়েক বছরের মাথায় তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। ১৯৮৭ সালে যোগ দেন রিপাবলিকান শিবিরে। এর আগে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন বলে কথিত আছে।
রাজনীতিতে নেমেই নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জানান দিয়ে বসেন ট্রাম্প। ১৯৮৮ সালে রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের রানিংমেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার জন্য নিজের নাম বিবেচনা করতে প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। বুশ এই অনুরোধটিকে ‘অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য’ বলে মনে করেছিলেন।
রিপাবলিকান পার্টিতে ট্রাম্পের প্রথম ইনিংস শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। এরপর রিফর্ম পার্টিতে যোগ দেন। আর দলটি থেকেই ২০০০ সালে প্রথবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার কথা ভাবেন। ব্যর্থ হয়ে পরের বছর চলে যান ডেমোক্র্যেট শিবির। সেখানে থিতু হতে পেরেছিলেন ৮ বছর। তারপর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান ২০০৯-এ। তাতেও শেষ হয়নি আলোচনার খোরাক। দুই বছরের মাথায় রিপাবলিকান পার্টিকে না বলে দেন। যোগ দেন ইনডিপেনডেন্ট পার্টিতে। এবারও ফিরে আসেন রিপাবলিকান পার্টিতে, অল্প সময়ের ব্যবধানে। ফিরেই ২০১২ সালে আবারও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু কারও সমর্থন না পাওয়ায় আর প্রতিযোগিতা করেননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। রিপাবলিকানদের মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। কিন্তু নাটকীয়তা থামেনি তার। জলবায়ু পরিবর্তনকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিসহ অন্তত ১০০টি জলবায়ু ও বাণিজ্য চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ট্রাম্প। ৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের জন্য সামরিক তহবিলের অর্থ ব্যবহার করেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন এবং প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বাণিজ্য চুক্তি এবং ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন ট্রাম্প। কোভিড-১৯ মহামারিতেও তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
২০১৯ সালে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তিনি ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক কোনও বিষয়’ খুঁজে বের করার জন্য ইউক্রেন সরকারকে চাপ দেন। এজন্য ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি পরিষদে তাকে অভিশংসিত করা হয়। তবে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন সিনেটে খালাস পেয়ে যান তৎকালীন এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে পরাজয় মেনে নিতে পারেননি ট্রাম্প। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থকদের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে জড়ো হয়ে প্রতিবাদের আহ্বান জানান। সেদিন বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণা করার কথা ছিল। ট্রাম্প সমর্থকদের সেই সমাবেশ দাঙ্গায় রূপ নেয় এবং তারা পার্লামেন্ট ভবনে হামলা করে। এই ঘটনায় ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হতে হয়। তবে এবারও সিনেটে পার পেয়ে যান। যদিও এই ঘটনায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুইটি ফৌজদারি মামলা চলমান।