শূন্য পাস ৬৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে আছে, আসল কাজে নেই

কলেজটির নাম নর্থ ওয়েস্টার্ন কলেজ। নাম দেখে মনে হতে পারে, বিদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে ঢাকার এই নামের কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন দুজন পরীক্ষার্থী। তবে দুজনেই অকৃতকার্য হয়েছেন।

কাগজপত্রে কলেজটির অবস্থান রাজধানীর শেওড়াপাড়ায়। বৃহস্পতিবার শেওড়াপাড়ায় গিয়ে পাওয়া গেল না কলেজের অস্তিত্ব। সেখানকার বেগম রোকেয়া সরণির যে ভবনে একসময় কলেজটি ছিল, সেখানে গেলে একাধিক ব্যক্তি জানালেন, একসময় এখানে কলেজটি ছিল। তবে কয়েক বছর আগেই কলেজ কর্তৃপক্ষ এখান থেকে চলে গেছে। কলেজটি শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছের একটি ভবনে গেছে। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ওই ভবনে গেলে সেখানকার একজন কর্মী জানান, কলেজটি এখন আর কার্যক্রমে নেই। এর বেশি কিছু বলতে পারেননি তিনি।

শুধু এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, মঙ্গলবার প্রকাশিত এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশ থেকে কলেজ ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি; যা গতবারের চেয়ে ২৩টি বেড়েছে। গতবার এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ৪২টি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। কোনোরকমে এসব প্রতিষ্ঠান চলছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলে, সেটাও বড় প্রশ্ন।

আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, সব সময়ই শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের মানোন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। যারা মানোন্নয়ন করতে পারে না, তাদের পাঠদান বা একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিলের ব্যবস্থা করা হয়।

পড়াশোনায় যা-তা অবস্থা

এবার মোট শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন কলেজ আছে আটটি। এর মধ্যে নরসিংদী সদর উপজেলার রাজাদী চিনিশপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর মাত্র দুজন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। দুজনই অকৃতকার্য হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার সকালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে দেখা যায়, ফটকে ও ভবনের সাইনবোর্ডে লেখা ‘রাজাদী চিনিশপুর হাইস্কুল’। ‘কলেজ’ শব্দটি নেই। প্রতিষ্ঠানটির মাঠে ফুটবল খেলতে দেখা যায় জনাবিশেক কিশোরকে। তারা কেউই বলতে পারল না, এখানে কলেজ শাখা আছে কি না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, গত বছর কলেজ পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি পায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। অনুমতি পাওয়ার পরও কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ায় স্থানীয় দুজন অনিয়মিত শিক্ষার্থীকে ধরে এনে রেজিস্ট্রেশন করানো হয়। তাঁরা দুজন আগে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। রেজিস্ট্রেশন করার পর পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগপর্যন্ত তাঁদের কোনো ক্লাস করানো হয়নি। এমনকি কলেজ পর্যায়ে কোনো শিক্ষকও নিয়োগদেওয়া হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক জানালেন, নতুন কলেজে কেউ ভর্তি হতে চায় না, তাই ধরে এনে অনিয়মিত দুই শিক্ষার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘দুজনই অকৃতকার্য হওয়ায় আমরা লজ্জিত ও মর্মাহত। শিক্ষার্থী না পাওয়ায় আমরা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে পারিনি।’

মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের চিত্র

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুটি মাদ্রাসা থেকে এবার কেউ পাস করতে পারেননি। এর মধ্যে একটি হলো পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তাফালবাড়িয়া হোসাইনিয়া আলিম মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসা থেকে এবারের আলিম পরীক্ষায় চারজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু কেউ পাস করতে পারেননি। আরেকটি হলো রাজশাহীর পুঠিয়া ধোকড়াকুল আলিম মাদ্রাসা। এখান থেকে মাত্র একজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে পাস করতে পারেননি। দুটি মাদ্রাসাই এমপিওভুক্ত। মানে, এই মাদ্রাসার শিক্ষকেরা সরকার থেকে মূল বেতনসহ আরও কিছু ভাতা পান।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেননি। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন করে এবং আরেকটিতে ছয়জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

দিনাজপুর বোর্ডে শূন্য পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি

সবচেয়ে বেশি শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এই বোর্ডের আওতাধীন ২০টি কলেজ থেকে কেউ পাস করেননি। এসব কলেজের প্রতিটিতে একজন থেকে সর্বোচ্চ আটজন করে পরীক্ষার্থী ছিলেন। যেমন ঠাকুরগাঁও কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন একজন পরীক্ষার্থী; কিন্তু পাস করতে পারেননি।

এ ছাড়া রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১২টি, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ৪টি, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ৫টি, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের ৪টি ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৭টি কলেজ থেকে কেউ পাস করতে পারেননি।

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে করণীয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই এমনটি হয়ে থাকে। তাই এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে উদাহরণ তৈরি করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে এগুলোকে

উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। তবে যথাযথ পরিদর্শন ও তদন্ত করে যদি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রয়োজনের চেয়ে প্রতিষ্ঠান বেশি, তাহলে সেগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।