শিরোনামের প্রশ্নটার উত্তর এককথায় দেওয়া মুশকিল। সাকিব আল হাসান আসলে কার কাছে হেরে গেলেন? তাঁর মতো ক্রিকেটার বাংলাদেশে এর আগে আসেনি, আবার কবে আসবে, কে জানে! বাংলাদেশের ক্রিকেটের একমাত্র মহাতারকার বিদায় বেলাটা যখন এমন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে, তাঁর পক্ষে–বিপক্ষে এতটা বিভক্তি ছড়িয়ে দেয়; তখন মনে এক শব্দের একটা প্রশ্নই তো জাগেই—কেন?
সেই ‘কেন’র কোনো সদুত্তর নেই। আবার অনেক উত্তর। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সাকিব যেমন একের পর এক সাফল্যের পদ্মফুল ফুটিয়েছেন, তেমনি বিতর্কের জন্মও কম দেননি। শেষ বেলায় মানুষ সাফল্য মনে রাখছে না, বিতর্ক মনে রাখছে—এটাই হয়তো তাঁর নিয়তি।
সাকিবকে বহু বছর ধরে জানেন, এমন একজন কাল দুঃখ করে বলছিলেন, ‘আমি অবাক হয়ে যাই, তার মতো একজন ক্রিকেটারের ওপর মানুষের এত ক্ষোভ থাকে কী করে! সাধারণ মানুষের মধ্যে, ক্রিকেটের মানুষদের মধ্যে, এমনকি সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেককে পেয়েছি, যারা ওকে ঠিক পছন্দ করে না। এমন বর্ণাঢ্য একজন ক্রিকেটারের তো এটা প্রাপ্য ছিল না!’
‘সাকিব কার কাছে হারলেন’, প্রশ্নটার উত্তর চাইলে এ কথা থেকেও খুঁজে নিতে পারেন। তিনি আসলে হেরেছেন ‘পাবলিক সেন্টিমেন্টে’র কাছে, যে ‘সেন্টিমেন্ট’কে সবচেয়ে বেশি বিগড়ে দিয়েছে তাঁর রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত। এর আগপর্যন্ত বিতর্কের জন্ম দিয়ে সাকিব সমালোচনা যেমন শুনেছেন, ব্যাট-বলের পারফরম্যান্স দিয়ে সেসব সমালোচনা উড়িয়েও দিয়েছেন। আজ যিনি সাকিবের কোনো নেতিবাচক কাজে সমালোচনা মুখর হয়েছেন, কালই হয়তো তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে সাকিব আল হাসান একজনই আছে।
কিন্তু যে–ই না তিনি রাজনীতিতে এসে বিতর্কিত এক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন, সেই মুহূর্ত থেকে সাকিবের ভক্তকুল স্পষ্টত দুই ভাগ হয়ে গেল। যার ছোট অংশটা তখনো ক্রিকেটার সাকিবকেই বড় করে দেখতে চাইল। কিন্তু দল–মত নির্বিশেষে বৃহৎ অংশের কাছে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর ‘লোভী’ রূপ। ‘লোভী’ এই অর্থে যে ক্রিকেট তো তাঁকে সবই দিয়েছে। তাহলে রাজনীতিতে এসে ক্ষমতা ছাড়া তাঁর আর কী পাওয়ার ছিল? সাকিব যতই বলুন, তিনি চেয়েছিলেন এলাকার মানুষের উন্নয়ন, দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
এরপর এল গত জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সাকিবের তখনকার নীরবতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর স্ত্রীর বিদেশে সুখী জীবনের ছবি পোস্ট করা ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট’কে আরও অগ্নিগর্ভ করে তোলে। যাঁরা সংসদ সদস্য সাকিবের মধ্যেও ক্রিকেটার সাকিবকে খুঁজে ফিরেছেন, তাঁদের হতাশ করে দিয়ে সাকিব নিজেই যেন ভুলে গেলেন, তিনি একজন ক্রিকেটারও। ক্রিকেটের মহাতারকা হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সবার, শুধুই একটি দলের নন। যাদের করতালিতে অনুপ্রাণিত হয়ে সাকিব ‘সাকিব’ হয়েছেন, তিনি তাদের পাশে দাঁড়ালেন না। তিনি হয়ে থাকলেন রাজনীতিবিদ।
সাকিবের ওই ভুলে যাওয়া কিংবা ভুলে থাকার চেষ্টাটাই তাঁকে দিয়েছে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য প্যাট্রিয়টে’র পরিণতি। যে বাংলাদেশকে তিনি একটার পর একটা উল্লাসের মূহূর্ত এনে দিয়েছেন, সেই বাংলাদেশেই আজ সাকিব অনাহূত! অনিরাপদ!
বলতে পারেন, এখনো তো কিছু মানুষ চান, সাকিব দেশের মাটিতে শেষ টেস্টটা খেলুন। হ্যাঁ, চান। কিন্তু সেই দাবি কতটা জোরালোভাবে জানাতে পারছেন তাঁরা? ফেসবুকের কিছু পোস্ট তো আর সমগ্র জাতির ভাবনাকে তুলে ধরে না!
অবশ্য আরেকটি বিষয়ও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কাছে–দূরের যাদেরই সাকিব বিভিন্ন সময় কারণে–অকারণে, বুঝে–না বুঝে অপ্রিয় হয়েছেন, সুযোগ বুঝে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে তারাও এখন তাঁকে গোপন ঈর্ষার ফলায় বিদ্ধ করছেন। নইলে মাত্র ৭–৮ মাসের রাজনৈতিক পরিচিতি তাঁর ১৭ বছরের কীর্তিময় উজ্জ্বল ছবিটাকে এভাবে মুছে দিতে পারত না।
কিংবদন্তি সাকিবকে যে বিদায় লগ্নে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া যাচ্ছে না, অনেকের চোখে এটাও তার একটা কারণ বলে মনে হচ্ছে। ওদিকে সাকিবের ইচ্ছা পূরণ করতে যাওয়াটা বর্তমান সরকারের জন্যও বড় এক স্ববিরোধী পদক্ষেপ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে তাঁর দেশে ফিরে খেলার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শঙ্কাই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। সাকিবকে সে কারণেই জানিয়ে দেওয়া, এ মুহূর্তে দেশে না আসাটা তাঁর জন্য মঙ্গলজনক। শেষ টেস্ট খেলতে দেশে আসার পথে সাকিবের পা তাই আটকে গেল দুবাইয়ের মরূদ্যানে।
সাকিবের আরেকবার বাংলাদেশের জার্সি পরার বিরোধিতা করে কাল বিসিবি কার্যালয়ে যে দলটি স্মারকলিপি দিয়ে গেল, তারা সংখ্যায় খুব বড় না হলেও দেশের বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সরকার দৃশ্যত সেই অংশের ‘সেন্টিমেন্ট’টাকেই অগ্রাহ্য করতে পারেনি। বিসিবিও সেই ‘সেন্টিমেন্টে’র কারণেই পারেনি দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকার হয়ে জোর লড়াইয়ে নামতে। তাদের ভয়, এক সাকিবকে বিদায়ী সংবর্ধনা জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই না বড় ক্ষতি হয়ে যায়! আর সাকিব সেই অংশের ‘সেন্টিমেন্ট’টাই পারেননি বুঝতে, কিংবা বুঝতে চাননি।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাকিব খেললে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে যেকোনো ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার শঙ্কা থেকে যেত। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দল তো বটেই, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারত বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওপরেও। আর সামনেই তো বিপিএল। তার আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেকোনো নেতিবাচক ঘটনা এই টুর্নামেন্টের ব্যাপারে বিদেশি ক্রিকেটারদের নিরুৎসাহিত করে তুলতে পারে। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহীতাদের মনে হয়েছে, সাকিবের এখন দেশে এসে না খেলাই তাঁর এবং দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো।
দুবাইয়ে বসে সাকিবেরও কি তা–ই মনে হচ্ছে? হয়তো হচ্ছে, হয়তো হচ্ছে না। যেটাই হোক, সাকিব অন্তত এই ভেবে তৃপ্তি পেতে পারেন যে ‘সারাটা ক্যারিয়ার তো খেলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিলাম। এবার না হয় না খেলেই দেশের ক্রিকেটের একটা বড় উপকার করে দেই।’
‘সাকিব কার কাছে হেরে গেলেন’, প্রশ্নটার উত্তরে তখন অন্তত তাঁর মনে এই উপলব্ধি আসবে না যে ‘হেরেছি তো আসলে নিজের কাছেই!’