<

নাদাল–জোকোভিচ: যেভাবে শুরু হয়েছিল টেনিসের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ

ঘোষণাটা একজন রাফায়েল নাদালের। স্পেনের টেনিস কিংবদন্তি জানিয়েছেন, নম্ভেম্বারেই ইতি টান্তে যাচ্ছেন পেশাদার ক্যারিয়ারের। ব্যক্তি নাদালের অবসরের সঙ্গে ইতি ঘটছে টেনিসের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথেরও। থেমে যাচ্ছে টেনিসের আরেক কিংবদন্তি নোভাক জোকোভিচের সঙ্গে তাঁর অবিস্মরণীয় লড়াই।

টেনিসের উন্মুক্ত যুগে সবচেয়ে বেশি ৬০ বার মুখোমুখি হয়েছেন নাদাল-জোকোভিচ। টেনিস ইতিহাসে আলোড়ন তোলা লড়াইয়ের তালিকায় ঢুকে গেছে দুজনের বেশ কয়েকটি ম্যাচ। ৩৮ বছর বয়সী নাদাল ও ৩৭ বছর বয়সী জোকোভিচ সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছেন রোলাঁ গারোতে, প্যারিস অলিম্পিকের দ্বিতীয় রাউন্ডে। এখন থেকে দেড় যুগ আগে ২০০৬ সালে দুজনের প্রথম দেখাও ছিল একই কোর্টে, ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে।

গ্র্যান্ড স্লাম, মাস্টার্স, ডেভিস কাপ আর অলিম্পিক মঞ্চে ছড়ানো নাদাল-জোকোভিচ দ্বৈরথে ৩১-২৯ ব্যবধানে এগিয়ে জোকো। ব্যবধানই বলে দিচ্ছে, কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াই হয়েছে দুজনের মধ্যে। কেমন ছিল নাদাল-জোকোভিচের এই জমজমাট দ্বৈরথের শুরুটা? ১৮ বছর আগের সেই প্রথম ম্যাচের দিকে ফিরে তাকিয়েছে এএফপি।

ম্যাচের আগে

নাদাল তখন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। আগের বছরই রোলাঁ গারোতে জিতেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম। বিপরীতে জোকোভিচ তখনো নিতান্তই নতুন। এটিপি র‍্যাঙ্কিংয়ে যাঁর অবস্থান ৬৩ নম্বরে। তবে শেষ আটে ওঠার পথে শীর্ষ ৩০-এর তিনজনকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসী জোকোভিচ তখন টগবগ করে ফুটছেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়নের বিপক্ষে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে বলে দিলেন, ‘আমি শুধু খেলতে আসিনি, জিততে এসেছি।’

সেই ম্যাচ

জোকোভিচের আশা ছিল, ফরাসি দর্শকেরা তাঁকেই সমর্থন করবেন। আর সেটার অংশ হিসেবে ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন ফ্রান্স ফুটবল দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে (ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালের পর শুরু হওয়া ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে ফাইনালে খেলেছিল ফ্রান্স)।

তবে কোয়ার্টার ফাইনালে নাদালের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর সময় হতাশই হতে হয়েছে জোকোভিচকে। কারণ, অধিকাংশ আসনই দেখা গেল ফাঁকা। এমনকি কাছের ভিআইপি রেস্তোরায় দুপুরে যে সমাগম হয়েছে, সেটাও হয়নি নাদাল-জোকোভিচের কোর্টে। ম্যাচের প্রথম গেমেই নাদাল ব্রেক করেন। পাল্টা ব্রেক করেন জোকোভিচও। আরেকটি ব্রেকে নাদাল এগিয়ে যান ২-১ ব্যবধানে, সেট জেতেন ৬-৪ গেমে। দুজনই ছিলেন নিজেদের সহজাত রূপে, যা গত দেড় যুগে দর্শকদের চোখে খুব চেনা হয়ে উঠেছে। ম্যাচের ধারাভাষ্যকারেরা গুনে চলছিলেন সার্ভিসের মাঝে জোকোভিচ কতবার বল ড্রপ করাচ্ছেন…১৪, ১৫, ১৬। অন্যদিকে ক্যামেরার ফ্রেমে দেখা মিলছিল নাদালের ডান পায়ের জুতায় লেখা ‘ভামোস’।

সাদা ব্যান্ডানা দিয়ে বাঁধা কাঁধসমান চুলের নাদালই হাসেন শেষ হাসি। দ্বিতীয় সেটটাও জেতেন ৬-৪ ব্যবধানে। আর তৃতীয় সেটে যখন ৩ পয়েন্টে এগিয়ে, এমন সময়ে পিঠের চোটে অবসর নিয়ে নিলেন জোকোভিচ। নাদাল ক্লে কোর্টে জিতে নিলেন টানা ৫৮তম ম্যাচ।

ম্যাচের পরে
ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে সবাইকে অবাক করে জোকোভিচ বলেন, ‘আমার তো মনে হয় ম্যাচ আমিই নিয়ন্ত্রণ করেছি। আমি ভালো খেলছিলাম। সবই আমার র‍্যাকেটের ওপর নির্ভর করছিল। এমনকি পিঠে ব্যথা নিয়েও আমি তাল মিলিয়ে খেলছিলাম।’ জোকোভিচ বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাবি করেন, ‘আমি আজ জিততে পারতাম। সে (নাদাল) অজেয় নয়।’

পরে নাদাল সংবাদ সম্মেলনে এলে তাঁকে জোকোভিচের বলে যাওয়া মন্তব্যগুলো জানিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনিও কি তাঁর সঙ্গে একমত? শুনে অবাক হন নাদাল। ঠিকঠাক শুনেছেন কি না, বুঝতে একজনকে জোকোভিচের কথাগুলো স্প্যানিশে অনুবাদ করে দিতে বলেন। এরপর মুখে হাসি এনে নাদালের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘ওহ্‌, হ্যাঁ।’ এরপর বলেন, ‘যদি ওর মনে হয়ে থাকে (ম্যাচের নিয়ন্ত্রক ছিল), তবে তা-ই। আমার জবাব দেওয়ার দরকার নেই।’

অবাক টিভি পণ্ডিতেরাও

৪-৬, ৪-৬ সেটে হেরেও জোকোভিচের ম্যাচে নিয়ন্ত্রক থাকার দাবিতে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে বিশ্লেষকদেরও। ইএসপিএনের ধারাভাষ্যকার ব্রাড গিলবার্ট জোকোভিচকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার কি মাথায় বুদ্ধি বাড়ানো দরকার? তুমি যদি রাফাকে উত্তেজিত করতে চাও, তাহলে আবার যখন খেলবে, ও তোমাকে চুরমার করে দেবে। এটা (ম্যাচ) ছিল হেভিওয়েট বনাম মিডলওয়েট।’

গিলবার্ট অবশ্য ভুল বলেননি। ক্লে কোর্টে দুজনের মুখোমুখি হওয়া প্রথম ৯ ম্যাচের সব কটিতে জিতেছিলেন নাদাল। জোকোভিচকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১১ সালে মাদ্রিদের ম্যাচ পর্যন্ত। প্রথমবার জোকোভিচের মুখোমুখি হওয়ার বছরও ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতেছিলেন নাদাল, জেতেন ২০০৭, ২০০৮ সালেও। স্প্যানিশ কিংবদন্তির হাতে বছরের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লামটি ওঠে ২০১০ থেকে টানা পাঁচ বছর, এরপর ২০১৭ থেকে টানা চার বছর। মাঝে ২০২১ বাদ দিয়ে ২০২২ সালেও।

এর মধ্যে ২০১২, ২০১৪ ও ২০২০ ফাইনালে জোকোভিচকেই হারান নাদাল। আর সার্বিয়ান তারকাও অবশ্য লড়াইটা একপক্ষীয় থাকতে দেননি। নাদালের টানা পাঁচ ট্রফি জয়ের দাপট ভেঙে ২০১৬ সালে জেতেন রোলাঁ গারোর প্রথম ট্রফি। এরপর তাঁর রেকর্ড ২৪ ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লামে যোগ হয় ২০২১ ও ২০২৩ ফ্রেঞ্চ ওপেনও। আর সর্বশেষ ২০২৪ অলিম্পিকেও শেষ হাসি জোকোরই। দ্বিতীয় রাউন্ডে নাদালকে ৬-১, ৬-৪ সেটে হারিয়ে বলেছিলেন, তাঁর ক্যারিয়ারে পাওয়া ‘গ্রেটেস্ট ট্রায়াম্ফ’।

এমন গ্রেটেস্ট ট্রায়াম্ফ আর দেখা যাবে না।