৩৫ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না

প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার লক্ষ্যে গড়ে তোলা শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও কর্মীরা তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। বেতন কবে হবে, সেই নিশ্চয়তাও নেই। সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ না নিলে বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা শিশুদের চিকিৎসা ঝুঁকিতে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে ৩৫টি। এর একটি আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগে। ২১ অক্টোবর ওই কেন্দ্রে ১৪ জন শিশু চিকিৎসার জন্য এসেছিল। তাদের মধ্যে ছয়জনের ছিল সেরিব্রাল পালসি, দুজনের ডাউন সিনড্রোম, দুজনের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, দুজনের মৃগীরোগ ও দুজনের বাক্‌প্রতিবন্ধিতা ছিল। কর্মকর্তারা জানালেন, আগের দিন এই ধরনের নানা সমস্যায় ভোগা ৩২ জন শিশুকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল।

এর আগে ১০ অক্টোবর এই কেন্দ্রে কথা হয় মোহাম্মদ পরশমনির সঙ্গে। তাঁর সংসার চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে চা বিক্রি করে। তাঁর একটিমাত্র ছেলে, বয়স দেড় বছর। ছেলের বয়স যখন সাত মাস, তখন খিঁচুনির সমস্যা ধরা পড়ে। ছেলেকে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে দেখান, পরে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেকে ওষুধ খাওয়াতে থাকেন। কিন্তু ছেলে পুরোপুরি ভালো হয় না।

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহের একদিন ছেলের প্রবল খিঁচুনি দেখা দেয়। মোহাম্মদ পরশমনি আবার চিকিৎসকের কাছ যান। চিকিৎসকেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আসার পরামর্শ দেন। তখন থেকেই ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে ছেলের চিকিৎসা চলছে। মোহাম্মদ পরশমনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডাক্তারেরা বলেছেন ছেলের ব্রেনের (মস্তিষ্ক) সমস্যা। চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে।’ চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, শিশুটির সেরিব্রাল পালসি।

কেন্দ্রগুলো কী সেবা দেয়

সব প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা এবং ইন্দ্রীয় বিকাশের সুযোগ বাড়াতে ২০০৮ সালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এসব শিশুর সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এখন সারা দেশের ২৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ১১টি জেলা সদর হাসপাতালে একটি করে মোট ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে। ১০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে এসব কেন্দ্রে স্বল্প সময়ে বিশেষায়িত সেবা দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৯৩৪ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু চিকিৎসা নেয়।

ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মনোবিজ্ঞানী আফরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশের জেলার শিশুরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। স্নায়বিক বৈকল্যজনিত সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, অটিজম, অতিচঞ্চলতা ও মনোযোগের অভাব, মৃগীরোগ, বাক্‌প্রতিবন্ধিতা, শিক্ষণ প্রতিবন্ধিতা ও আচরণগত সমস্যা আছে—এমন শিশুদের এই কেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, যেকোনো হাসপাতালে এসব শিশুর সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না, সঠিক চিকিৎসাও হয় না।

তিন মাস বেতন কেন বন্ধ

একেকটি কেন্দ্রে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্ট, অফিস ব্যবস্থাপক ও ক্লিনার মোট পাঁচজন জনবল থাকে। ৩৫টি কেন্দ্রে জনবল আছে ১৭৫ জন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট শাখায় আছেন আরও ১১ জন।

স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির ‘হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক অপারেশন প্ল্যানের আওতায় শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়েছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রের অর্থায়ন হয় স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বাজেট থেকে। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি গত জুন মাসে শেষ হয়েছে। এর পর থেকে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে সারা দেশের কেন্দ্রগুলোর কেউ বেতন পাননি।

ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের আফরোজা বেগম বলেন, ‘তিন মাসের বেতন পাই না। কত দিন বেতন ছাড়া থাকতে হবে জানি না। চাকরি আছে কি না, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না—এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে অনেকেই কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা শিশুরা।’

শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর চাকচিক্য না থাকলেও বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা শিশুদের সেবা দিয়ে চলেছে তারা। যে ধরনের বিশেষায়িত সেবা কেন্দ্রগুলো দেয়, তা দেশের অন্য কোনো হাসপাতালে পাওয়া যায় না। ইতিমধ্যে কয়েকটি কেন্দ্র থেকে কর্মীরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অনিশ্চয়তা থাকলে এই প্রবণতা বাড়বে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রেখেছি।’