নারী বলেই কি কমলা এগোতে পারছেন না

নির্বাচনী জরিপে এক জায়গায় থমকে আছেন কমলা হ্যারিস। এক সপ্তাহ আগে তিনি জাতীয় জনমত জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে দুই পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। সে অবস্থার তেমন হেরফের হয়নি। অমীমাংসিত সাতটি অঙ্গরাজ্য, যেখানে এবারের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হবে, তার কোনো কোনোটিতে সামান্য হলেও ট্রাম্প এগিয়েছেন। অন্যদিকে পেনসিলভানিয়ায় কমলা আধা পয়েন্ট হারিয়েছেন। খ্যাতনামা জরিপবিশেষজ্ঞ নেইট সিলভার বলেছেন, ভাবসাবে মনে হচ্ছে কমলা নয়, ট্রাম্পই জিতবেন।

মনে রাখা ভালো, কমলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এমন একজনের (ট্রাম্প) বিরুদ্ধে, যিনি দুবার কংগ্রেসে অভিশংসিত হয়েছেন এবং ৩৪ দফা ফৌজদারি অপরাধে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। জেনারেল জন কেলি, যিনি ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ ছিলেন, তাঁকে ফ্যাসিস্ট নামে অভিহিত করেছেন। সাবেক রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির কন্যা ও একসময়ের প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেত্রী লিজ চেনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এই লোকটা প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। তিনি ও তাঁর বাবা উভয়েই ট্রাম্পকে নয়, কমলা হ্যারিসকেই ভোট দেবেন বলে আগাম জানিয়ে দিয়েছেন। তারপরও কী করে সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের দোরগোড়ায়?

কথা উঠেছে, হয়তো আমেরিকা এখনো একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করতে প্রস্তুত নয়। শীর্ষে পৌঁছাতে হলে মেয়েদের একটি অদৃশ্য বাধা-হিলারি ক্লিনটনের ভাষায় ‘গ্লাস সিলিং’ ভাঙতে হবে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। কমলার সামনে এখন সেই একই চ্যালেঞ্জ। তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তার একটা প্রধান কারণ হবে এ দেশের পুরুষদের, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের, নারী প্রেসিডেন্টের প্রশ্নে অনাস্থা।

গত সপ্তাহে পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে কমলার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় এসেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষদের ধমকে বললেন, তাঁরা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে কমলার প্রতি সমর্থনে অনাগ্রহী। ওবামা বলেন, ‘তোমরা এটা বলছ, সেটা বলছ, কিন্তু আদতে কথা হলো নারী বলেই তোমরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলার ব্যাপারে ইতস্তত করছ। তোমাদের উচিত তাঁকেই ভোট দেওয়া, কারণ সে তোমাদের মতো অবস্থা থেকে উঠে এসেছে।’

ওবামার উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গত তিন-চারটি নির্বাচনে এ দেশের আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটাররা যে সংখ্যায় বিল ক্লিনটন, ওবামা বা জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন, জনমত জরিপে অনুসারে কমলা ঠিক সেই রকম সাড়া পাচ্ছেন না। তাঁরা তিনজনই প্রায় ৯০ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষদের ভোট পেয়েছেন। এবার সেই সমর্থন ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। কমলার ব্যাপারে সবচেয়ে কম আগ্রহ আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণ ও যুবকদের। একইভাবে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে কমলা ১১ বা তার চেয়ে অধিক পয়েন্টে পিছিয়ে।

পুরুষ ভোটারদের এই অনাগ্রহের একটি কারণ, ট্রাম্প তাঁদের কাছে বলবান ও পুরুষোচিত নায়কের প্রতিনিধি। তিনি একজন ‘আলফা মেল’। আততায়ীর গুলিতে রক্তাক্ত হওয়ার পরও তিনি নুয়ে না পড়ে হাত উঁচিয়ে বলেন, ফাইট, ফাইট। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ উভয় পুরুষের কাছেই ট্রাম্পের এই ‘লড়াকু’ স্বভাব পছন্দ। ট্রাম্প বলেছেন, ক্ষমতা নিয়েই তিনি দেশের ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ বহিরাগতকে জোর করে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করে বহিষ্কার করবেন। যাঁরা বহিরাগতদের ব্যাপারে অ্যালার্জিতে ভোগেন, তাঁরা ট্রাম্পের এই আস্ফালনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও আফ্রিকান-আমেরিকান যেমন আছেন, তেমনই আছেন দক্ষিণ এশীয় ভোটাররা।

নারীবাদী ডেমোক্রেটিক পার্টি

মার্কিন পুরুষদের মধ্যে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে এ দেশের রাজনীতিকেরা, বিশেষত ডেমোক্রেটিক পার্টি, নারীর স্বার্থ রক্ষায় যতটা সচেতন, পুরুষদের ব্যাপারে ততটা নয়। গত অর্ধশতকে নারীবাদী আন্দোলনের ফলে মেয়েরা এখন আর ঘরে বসে নেই। সমাজে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রতিযোগিতায় তাঁদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হড়কে পড়ছেন আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষেরা। প্রথাগতভাবে তাঁরা নারীর প্রতি কম শ্রদ্ধাশীল, কম মনোযোগী। ইউগভ নামক এক জরিপ সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, আমেরিকার পুরুষেরা-সাদা-কালো উভয়েই চান রাজনীতিবিদেরা তাঁদের চাহিদা ও প্রয়োজনের প্রতি আরও মনোযোগী হোক। তাঁরা মনে করছেন ‘মি টু’ ও নারীবাদী আন্দোলনের প্রভাবে তাঁরা ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

এই মনোভাব ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই এই দলের ওপর নারীদের প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি নির্বাচনে তাদের জয়ের একটা প্রধান কারণ অস্বাভাবিক সংখ্যাধিক্যে নারী সমর্থন। নারী ভোটারদের প্রভাবেই এই দল ক্রমে অধিক বামঘেঁষা হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বে আগ্রহী পুরুষেরা ডানমুখী হচ্ছেন ও রিপাবলিকান পার্টির দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষত ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী পুরুষের চোখে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁদের স্বার্থের সেরা রক্ষক।

এই যে জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গ ব্যবধান, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পলিটিকস অব রিজেন্টমেন্ট,’ বা ক্ষোভের রাজনীতি। কানেটিকাট থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মার্ফি সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই ক্ষোভের প্রতি মনোযোগী না হলে ডেমোক্রেটিক পার্টি আগামী নির্বাচনে বিপদে পড়বে। একই কথা বলেছেন গার্ডিয়ান পত্রিকার স্যাম উলফসন। ইউগভের উপাত্ত ব্যবহার করে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে কি পুরুষ ভোটের জোরেই ট্রাম্প জিতে যাবেন?

কমলার জন্য সুখবর

কমলার জন্য একটি সুখবর হলো, পুরুষ সমর্থনে পিছিয়ে থাকলেও দেশের সব বর্ণের ও বয়সের মেয়েদের মধ্যে তাঁর সমর্থন ট্রাম্পের চেয়ে ২০ পয়েন্ট বা তার চেয়ে বেশি। সবচেয়ে বিস্ময়কর যা তা হলো ৫০ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী নারীরাই কমলার প্রধান ‘ভোটব্যাংক’। সংখ্যার হিসাবে তাঁরাই এ দেশের প্রধান ভোটদাতা। এক হিসাবমতে, এই বয়সী নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ এবং তাঁদের ৯৭ শতাংশ নিয়মিত ভোট দিয়ে থাকেন।

এই তথ্য কমলা খুব ভালো করেই জানেন এবং সে জন্যই তাঁর প্রচারের প্রধান নজর হচ্ছে গর্ভপাতের প্রশ্ন। গর্ভপাতের নিশ্চয়তা দাবির বদলে তিনি নিজের শরীরের ওপর নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছেন। তাঁর প্রচারের স্লোগানই হচ্ছে, ফ্রিডম বা স্বাধীনতা। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের জন্য বড় চিন্তা তাঁদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা। সে কথা মাথায় রেখেই কমলা স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি ‘মেডিকেয়ার’–এর সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ও জাতীয় পেনশন কর্মসূচি ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি’র কোনো পরিবর্তনের বিপক্ষে জোর আওয়াজ তুলেছেন।

অন্য কথায়, এবারের লড়াইটা শুধু ট্রাম্প ও কমলার মধ্যেই নয়, আমেরিকার নারী ও পুরুষ ভোটারদের মধ্যেও।