ভালো থাকুক মিঠাপানির শুশুক

গত মাসের শেষ সপ্তাহে খুলনার রূপসা নদীতে শুশুক দেখতে গিয়েছিলাম। সারা দিন নদীতে ঘুরে প্রায় এক ডজন শুশুক দেখলাম। নদীতে শুশুক বা ডলফিন দেখা সব সময়ই আমার কাছে উপভোগের। নদীর কোনো মোহনায় একটি শুশুকের দল পেলে সারা দিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যায়। শুশুকেরা ৩-৫ মিনিটের মধ্যে পানির ওপর লাফিয়ে ওঠে শ্বাস নেওয়ার জন্য। শ্বাস নেওয়ার জন্য যখন তারা পানির ওপর ওঠে, তার সময়কাল মাত্র কয়েক সেকেন্ড হয়। নিমেষেই তারা চোখের আড়াল হয়ে যায়। এত কম সময়ে তাই শুশুকের ছবি তোলাও খুবই কঠিন।

গত সাত বছর নিয়মিত রূপসা আর সুন্দরবন এলাকার নদীতে শুশুক দেখতে যাই। আগের বছরগুলোর তুলনায় এই নদীতে শুশুকের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। বেড়ে গেছে নদীর ওপর চাপ। নদীতে নৌযানের চলাচল এখন অনেক বেশি। এ এলাকায় আগের চেয়ে কলকারখানাও বেড়েছে। এসব কারণে নদীর পানিতে বর্জ্য মিশে যাচ্ছে নদীতে। পানিদূষণের বড় প্রভাব পড়ছে এই প্রাণীর ওপর।

মিঠাপানির শুশুকের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হলো আমাদের পদ্মা ও যমুনা নদীর বিভিন্ন মোহনা। এই নদীগুলোর বিভিন্ন শাখা নদীতেও একসময় নিয়মিত শুশুকের দেখা পাওয়া যেত। বর্তমানে এর সংখ্যাও বেশির ভাগ এলাকায় অনেক হারে কমে গেছে। এর বড় কারণ হলো শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যায়। নিয়মিত নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। আর নদীর ভালো অংশে জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে যত শুশুক মারা যায়, তার ৭৯ ভাগই নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে আটকে মারা পড়ে। শুশুকের ঠোঁট লম্বা আর মাড়িতে দাঁতের কারণে সহজেই কারেন্ট জালে আটকা পড়ে। আর এই আটকে পড়া শুশুক পানির ওপরে উঠে শ্বাস নিতে না পারার কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা পড়ে।

বাংলাদেশে সাত জাতের ডলফিন ও এক জাতের পরপয়েস দেখার তথ্য আছে। এর মধ্যে প্রকৃত মিঠাপানির ডলফিন মাত্র একটি। এর নাম গাঙ্গেয় শুশুক। ইংরেজিতে বলে গ্যানজেস রিভার ডলফিন। বিশ্বব্যাপী আইইউসিএনের লাল তালিকায় এই প্রাণী এখন বিপন্ন। সারা পৃথিবীতে এ জাতের ডলফিনের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপালের নদীগুলোতে শুশুকের উপস্থিতি আছে। তবে বাংলাদেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় শুশুক দেখা যায়। শুশুক ছাড়াও ইরাবতী ডলফিন নামের আরেক জাতের ডলফিন আছে, যা উপকূল অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। অনিয়মিতভাবে মাঝেমধ্যে মিঠাপানির নদীতে চলে আসে।

শুশুক খুবই বুদ্ধিমান প্রাণী। এরা স্তন্যপায়ী হওয়ায় সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে ও বাচ্চা লালনপালন করে। দিন-রাতের প্রায় সারাক্ষণই তারা সজাগ থাকে। পুরো সময়ের মাত্র ১৫-২০ মিনিট এরা ঘুমায়। এ সময়ও মস্তিষ্কের অর্ধেকটা অংশ বিশ্রাম নেয়। শরীরের অন্যান্য অংশ সচল থাকে। শুশুকেরা দলবদ্ধভাবে খাবার ধরার চেষ্টা করে এবং দলের একে অপরকে বন্ধুর মতো সহযোগিতা করে।

বাংলাদেশে ডলফিন রক্ষায় খুব বেশি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। এ দেশে ডলফিন সংরক্ষণে ৯টি অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে সরকার, যা ডলফিন রক্ষায় ভালো খবর। তবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়া আর কারেন্ট জালের দৌরাত্ম্যে অভয়ারণ্যগুলোর অবস্থাও এখন ভালো নয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বন অধিদপ্তর আর মৎস্য অধিদপ্তর একযোগে পদক্ষেপ না নিলে এসব অভয়ারণ্যে ডলফিন সংরক্ষণ খুবই দুরূহ।

শুশুক আমাদের মিঠাপানির নদীগুলোর প্রাণ। এই প্রাণী আমাদের সংস্কৃতিরও বড় অংশজুড়ে আছে। নদীগুলো ভালো থাকলেই কেবল শুশুকেরা ভালো থাকবে। আর নদীতে শুশুক থাকলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ভালো থাকবে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস। শুশুককে ‘জাতীয় জলের প্রাণী’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। আশা করি শুশুক আমাদের নদীতে টিকে থাকবে অনন্তকাল।