পাকিস্তানে যেভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শেষ হলো

পাকিস্তানের সংবিধানের ২৬তম সংশোধনী পাস হয়ে গেল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শেষ করে দেওয়া হলো। দিনটা পাকিস্তানের সংসদীয় ইতিহাসের এক অন্ধকার রাত। বেলুচিস্তানের বিরোধী দলের দুই আইনপ্রণেতার চোখ দিয়ে দেখুন। একজন হুইলচেয়ারে বসা আর অন্যজন গায়ে গাঢ় রঙের শালজড়ানো এক নারী সদস্য। তাঁদের বন্ধ করে রাখা মুখ বলছে কী সেই গল্প।

এই দুজন বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ বলে জানা যাচ্ছিল। নিরাপত্তারক্ষীরা কোনো সাংবাদিককে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি। তাঁদের ভোট ক্ষমতাসীন জোটকে উচ্চকক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যা পেতে সাহায্য করেছে।

সিনেট ভোটের পর মধ্যরাতে জাতীয় পরিষদের বৈঠক হয়। আধডজন বিরোধী বিধায়ক ট্রেজারি বেঞ্চে হাজির হন। মজার ব্যাপার হলো তাঁরা কয়েক দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। নিখোঁজ থেকে হাজির হওয়া দলত্যাগকারী এই নেতাদের ভোট পাওয়ায় নিম্নকক্ষেও সংশোধনী পাসের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা পূরণ হয়েছে। পিপলস পার্টি অব পাকিস্তানের (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো যে ‘ব্রুট মেজরিটি’ ব্যবহার করার হুমকি দিয়েছিলেন, তা এভাবেই বাস্তবায়িত হলো।

২০ ও ২১ অক্টোবর রাতে যা ঘটেছে, তা সংবিধানের একটা ভিত্তিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর নেতারা বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে একের পর এক উদ্যোগে সফল হচ্ছেন। আর এই বিজয়কে তাঁরা গণতন্ত্র ও সংসদের জয় বলে ঘোষণা করছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে সিংহাসন নিয়ে আরও বড় কোনো খেলার তাঁরা ঘুটিমাত্র। দেশের এত বড় ক্ষতির বিনিময়ে এই বিজয় তাঁরা কি জেনেবুঝে উদ্‌যাপন করছেন? 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এর ফলে তো বিলাওয়ালের দলের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তথাকথিত নির্বাচিত বেসামরিক সরকার সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা নষ্ট করার জন্য যা করল, তা তো সামরিক সরকারও করতে পারেনি। নিজেদের পছন্দমতো তৈরি করা বিচার বিভাগ কেবল সংবিধানবহির্ভূত ক্ষমতার হাতকেই শক্তিশালী করবে।

২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে বরখাস্ত করেছিলেন প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী। পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং তার নেতা নওয়াজ শরিফ সেই বরখাস্ত করার পক্ষে ছিলেন। একইভাবে বিলাওয়ালসহ পিপিপি নেতারা ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দোষী সাব্যস্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নিরাপত্তা সংস্থার সমর্থন ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। এই দুটি রাজনৈতিক দল এখন একটা জোটের সদস্য। তারা স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে, যারা ক্ষমতার আসল মালিক তাদের খেলার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

ক্ষমতার আসল মালিকেরা এখন নতুন কৌশল করছে। আর এই দুই দল একযোগে তাদের সমর্থন করছে। ইসলামাবাদ হাইকোর্টের ছয়জন বিচারক বিচারিক বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ এবং বিচারকদের হয়রানির বিষয়ে কথা বলার পর এই নতুন কৌশল প্রয়োগ শুরু হলো। 

পৃথক সাংবিধানিক আদালত এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান–সংক্রান্ত কিছু ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করার পদক্ষেপের বিষয়ে খসড়ায় খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠনে নির্বাহী বিভাগের ভূমিকা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সংশোধনীটি সুপ্রিম কোর্টের সুয়োমোটো ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। প্রধান বিচারপতির মেয়াদ নির্ধারণ করেছে তিন বছর। আর প্রধানমন্ত্রীকে সিনিয়র সুপ্রিম কোর্টের তিনজন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারকের মধ্য থেকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে।

নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে এবং জবরদস্তিমূলক কৌশল ব্যবহার করে সরকার এই বিতর্কিত সংশোধনীটি পাস করতে পেরেছে। যেভাবে বিরোধী দলের সদস্যদের পক্ষ পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তা ছিল আপত্তিজনক। এই আইনপ্রণেতাদের পুরো সপ্তাহ বন্দী করে রাখা হয়েছিল। 

এমন বিতর্কিত, এমন সুদূরপ্রসারী যার প্রভাব, সেই সংবিধান সংশোধন নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। বেশির ভাগ বিধায়ককে খসড়াও দেখানো হয়নি। তাঁদের তো নিজ দলের নেতাদের নির্দেশ অমান্য করার কথা ছিল না। আমাদের সংসদীয় ইতিহাস গর্ব করার মতো কিছু নয়। কিন্তু গত সপ্তাহে যা ঘটেছে, তার কোনো নজির নেই।

তবে খেলা এখনো শেষ হয়নি। অধিকাংশ বার অ্যাসোসিয়েশন সংবিধানের সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করেছে। এই যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হলো, সে বিষয়ে নতুন প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান, তা এখন দেখার বিষয়। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সরকার ও ক্ষমতার মালিকদের পক্ষে এত সহজ হবে না।