ব্রিকসে সি-মোদির বৈঠকের পরও কি আশ্বস্ত হতে পারছে ভারত

রাশিয়ার কাজানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেন। আজ বুধবার বিকেলে সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি সরাসরি জানিয়ে দেন, সীমান্ত শান্ত ও স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি দুই দেশের কাছেই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

মোদি ওই বৈঠকে বলেন, বিশ্বশান্তির জন্য ভারত-চীনের সুসম্পর্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার প্রচেষ্টায় সাম্প্রতিক বোঝাপড়ার উল্লেখ করে মোদি বলেন, মতানৈক্য ও বিবাদের উপযুক্ত মোকাবিলা খুবই জরুরি। দেখা দরকার, বিবাদ যেন শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট না করে।

বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, সীমান্ত প্রশ্নের মীমাংসায় নিযুক্ত দুই দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিরা শিগগিরই বৈঠকে বসবেন। সীমান্তের শান্তি ও সুস্থিতি রক্ষার ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা হবে। সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী যুক্তিপূর্ণ, যথার্থ ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা তাঁরা খতিয়ে দেখবেন। নষ্ট হওয়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঠিক করতে ও স্থিতিশীল রাখতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য কাঠামোগত ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।

ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে সেই বৈঠক হয়েছিল ভারতের তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমে। পরের মাসেই ব্রাজিলে বসেছিল ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে এই দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে শেষবারের মতো প্রতিনিধিসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকের কয়েক মাস পরই ২০২০ সালের জুনে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) দুই দেশের সেনাবাহিনী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষে বহু সেনা হতাহত হয়েছিল।

ওই ঘটনার পর দুবার আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মোদি ও সির মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে। ২০২২ সালে জি-২০ সম্মেলনে দুই নেতা পারস্পরিক সাক্ষাতে কুশল বিনিময় করেছিলেন। পরের বছর ২০২৩ দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের অবসরেও তাঁদের দেখা হয়েছিল; কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। এলএসির স্থিতাবস্থা নিয়ে ভারতের দাবি মেটেনি। এবার ভারতের সেই দাবি কিছুটা মিটল। এবারের বৈঠক নিয়ে দুই দেশের প্রস্তুতি অনেক বেশি। সম্পর্কের বরফ যে গলছে, তার প্রমাণে দুই দেশই তৎপরতা দেখিয়েছে বৈঠকের আগে লাদাখ নিয়ে বোঝাপড়ার কথা ঘোষণা দিয়ে।

দুই দেশের সেনাবাহিনী এলএসি পরিস্থিতি নিয়ে এই পাঁচ বছরে ২০টির বেশি বৈঠক করেছে। বৈঠক হয়েছে কূটনৈতিক স্তরেও; কিন্তু সীমান্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ভারত বারবার জানিয়েছে, সংঘর্ষের আগে দুই বাহিনী এলএসিতে যে অবস্থানে ছিল, সেখানে ফিরে না গেলে সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হতে পারবে না।

রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের অবসরে দুই নেতার এই বৈঠকের আগে ভারত ও চীন লাদাখের সীমান্ত পরিস্থিতি আরও কিছুটা স্বাভাবিক করে তোলার কথা ঘোষণা করে। গত সোমবার ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ২০২০ জুনের আগে লাদাখে দুই বাহিনী যেখানে টহল দিত, সেই জায়গায় টহল দিতে পারবে এবং এই বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করেই সীমান্তে সেনা অপসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভারতের দিক থেকে এই ঘোষণার পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই বিবৃতি দেয়। এরপরই কাজানে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব দুই নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা ঘোষণা করেছিলেন।

পাঁচ বছর পর লাদাখে সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা ও দুই নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই চীনের তাগিদ ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আসতে শুরু করেছে সাবধানবাণীও। সীমান্ত সংঘর্ষ ও উত্তেজনা সত্ত্বেও বছর বছর ভারত-চীন বাণিজ্যের বহর বেড়ে চলেছে। ২০২৩-২৪ সালের অর্থবর্ষে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বহর ছিল ১১৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারতের রপ্তানি ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তুলনায় চীন থেকে ভারতের আমদানি ছিল ১০১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের এই অসম সম্পর্কের মাঝেই সীমান্ত বোঝাপড়ার খবরে ওয়াকিবহাল মহল সরকারকে সতর্ক করেছে। চীনে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম বাম্বাওয়ালে আজ বুধবার এক নিবন্ধে লিখেছেন, এলএসি বরাবর ২০২০ সালের আগের স্থিতাবস্থা ফেরার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া এবং টহলদারির বিষয়টি কঠোরভাবে মানা হবে, সেই নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত অতীতে গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্তগুলো বদল করা উচিত হবে না।

সেই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতে বিভিন্ন চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা এবং ৫-জি ও ৬-জি স্পেকটার্মে চীনা সংস্থাগুলোকে ঢুকতে না দেওয়া। তিনি স্পষ্ট লিখেছেন, হুয়াউই এবং জেডটিই সংস্থার কাছে ভারতের টেলিকম শিল্পের পরিকাঠামোর দরজা বন্ধই থাকা উচিত।