ছাত্র আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সুহার্তোর জামাতা প্রাবোও এখন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট

ইন্দোনেশিয়ার সাবেক জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্তো আজ রোববার দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পার্লামেন্টে শপথ নিয়েছেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির জন্য পরিচিত মুখ হয়ে ওঠা ৭৩ বছর বয়সী প্রাবোও।

শপথ অনুষ্ঠানে প্রাবোও সুবিয়ান্তো বলেন, ‘শপথ করছি যে আমি ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব যতটা সম্ভব ততটা ভালোভাবে ও ন্যায্যভাবে পালন করব।’ একই সঙ্গে তিনি ইন্দোনেশিয়ার নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে আরও সরব থাকারও ইঙ্গিত দেন তিনি।

প্রাবোও সুবিয়ান্তো শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে। সেখানে উপস্থিত আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার সব নাগরিকের, এমনকি যাঁরা আমাদের ভোট দেননি, তাঁদের স্বার্থকেও অগ্রাধিকার দিয়ে…আমরা ইন্দোনেশিয়া সরকারকে নেতৃত্ব দেব।’ এ সময় আইনপ্রণেতারা তাঁর নামে স্লোগান দেন এবং সাধুবাদ জানান।

এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ঘিরে রাজধানী জাকার্তায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক লাখ পুলিশ ও সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়। ১৯৪৫ সালে ডাচ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রাবোও দেশটির অষ্টম প্রেসিডেন্ট হলেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড লামি, চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হান ঝেংসহ বেশ কিছু বিদেশি কূটনীতিক অংশ নেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার পরপরই অনানুষ্ঠানিক ভোট গণনায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুবিয়ান্তো এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জিবরান রাকাবুমিং রাকাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০ মার্চ দেশটির নির্বাচন কমিশন তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণা করে। জিবরান রাকাবুমিং রাকা হলেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর বড় ছেলে।

ইন্দোনেশিয়ার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী যদি প্রথম দফায় ৫০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত না করতে পারেন, তবে নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়। তবে প্রাবোও প্রথম দফার ভোটাভুটিতেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেন।

অভিজাত পরিবারের সদস্য

প্রাবোও ইন্দোনেশিয়ার একটি অভিজাত পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা সুমিত্র জোজোহাদিকুসুমো দেশটির একজন নামকরা অর্থনীতিবিদ ছিলেন। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা সুকার্নো ও স্বৈরাচার সুহার্তোর শাসনকালে তিনি অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রাবোওর দাদা ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ছোট ভাই হাশিম জোজোহাদিকুসুমো একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। প্রাবোওর ছোটবেলা কেটেছে সুইজারল্যান্ড, হংকং, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। ১৯৭০ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়ার সামরিক একাডেমিতে যোগ দিতে দেশে ফেরেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ১৯৮৩ সালে প্রাবোও সুহার্তোর দ্বিতীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। পরে অবশ্য এই দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

মানবাধিকার লঙ্ঘন

১৯৯৮ সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে সুহার্তো যখন পদচ্যুত হন, তখন প্রাবোও সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিক্ষোভ দমনে বিশেষ অভিযান চালিয়েছিল এই বাহিনী।

অধিকারকর্মীরা এবং তাঁর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, সুহার্তোর শাসনের শেষের দিকে প্রাবোও প্রতিবাদকারীদের তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে অপহরণ করার জন্য প্রাবোওকে সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ গঠন হয়নি।

প্রাবোওর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকায় ইন্দোনেশিয়ার মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র একবার তাঁকে ভিসা দেয়নি। এমনকি ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ভিসা দেওয়া হবে না, এমন ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নাম যুক্ত করে অস্ট্রেলিয়া। তবে গত দশকে দুই দেশই তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

প্রাবোও পূর্ব তিমুরে সামরিক অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর আক্রমণ করে ২০০২ সাল পর্যন্ত দখল করে রাখে। সুহার্তোর পতনের পর প্রাবোও জর্ডানে পালিয়ে যান এবং ২০০৪ সালে দেশে ফেরেন।

জোকোর সঙ্গে সংযোগ

প্রাবোও এর আগে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোকো উইদোদোর কাছে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি অভিযোগ করেন, দুই নির্বাচনেই জোকো প্রতারণা করেছেন। এরপর দুজনের মধ্যে সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে জোকোই ২০১৯ সালের নির্বাচনের অল্প কিছুদিন পর প্রাবোওকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

গত বছর প্রাবোও আবারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন—জোকোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন। তাঁর রানিং মেট হবে জোকো উইদোদোর বড় ছেলে জিবরান রাকাবুমিং রাকা। জোকোর সমর্থন নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা নির্বাচনে বড় ধরনের বিজয় পান।

অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, জোকো নির্বাচনে কারচুপি করেছেন এবং তাঁদের বিজয় নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে।

বিশ্বমঞ্চ

প্রাবোও নির্বাচনে জয়ের পর থেকে জোকোর বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ বিষয়কে তিনি অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছেন। তবে তিনি বিশ্বমঞ্চে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখারও ইঙ্গিত দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ইতিমধ্যে তিনি জাপান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, ভিয়েতনামসহ ১২টির বেশি দেশ সফর করেছেন।

গত এপ্রিলে প্রাবোও চীন সফর করেন। আর জুনে জর্ডানে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় গত আগস্টে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নতুন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেন। সেখানে প্রতিবেশী দেশ দুটি এ ধরনের হুমকিতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেইজিংয়ের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোর প্রতিরক্ষায় প্রাবোও আরও দৃঢ় হবেন।

বড় প্রতিশ্রুতি

নতুন রাজধানী নুসান্তরা নির্মাণ প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রাবোও। সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর কয়েক শ ডলারের এ প্রকল্প নেন। তাঁর বিদায়ের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্প বাতিল হতে পারে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

প্রাবোও অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল মিল চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে খরচ হবে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর এতে উপকারভোগী হবে ৭ কোটির বেশি ইন্দোনেশিয়ান।

তবে সমালোচকেরা বলছেন, প্রাবোও দুটি প্রকল্প চালাতে পারবেন না। এটি হলে রাষ্ট্রের কোষাগারের ওপর বিশাল চাপ পড়বে।

তবে প্রাবোও আশাবাদী, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ৮ শতাংশ হবে। প্রাবোও বলেন, তিনি দেশকে খাদ্য, জ্বালানি ও পানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দিকে লক্ষ রাখবেন।