মাহমাদুল্লার একটুও আক্ষেপ নেই

দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলন কক্ষটা একটু অন্যরকম। মিডিয়া সেন্টারের নিচেই চেয়ার-টেবিল বসিয়ে সংবাদ সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছে দিল্লি ও ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (ডিডিসিএ)। মাহমুদউল্লাহ আজ সেখানে বসেই টি-টোয়েন্টি সংস্করণ থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।

কিন্তু অনেক উত্থানপতনের দীর্ঘ ১৭ বছরের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শেষের ঘোষণাটা যখন দেবেন, তখনই হোঁচট খেতে হলো মাহমুদউল্লাহকে। অবসরের গুঞ্জন প্রসঙ্গে প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই দেখা যায় মাইক্রোফোন কাজ করছে না!

মাইক্রোফোন ঠিক করার জন্য ডিডিসিএ’র কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না বাংলাদেশ দলের মিডিয়া ম্যানেজার রাবীদ ইমাম। পরে স্থানীয় এক সাংবাদিকের ফোন পেয়ে ডিডিসিএ’র দুজন লোক এসে মাইক্রোফোন ঠিক করে দেন। এতেই চলে গেল মিনিট ছয়েক। এর মধ্যে মাহমুদউল্লাহ হাসলেন, খুনসুটি করলেন। সাংবাদিকেরা তাঁকে মাইক্রোফোন ছাড়াই প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেন। তিনিও মজা করে বলেন, ‘মাইক্রোফোন ছাড়া কত জোরে বলব, মাইক্রোফোনের মতো তো বলা যাবে না (হাসি)।’

আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার পর প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই ভারতের বিপক্ষে চলতি সিরিজটিকে নিজের শেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজ বলে ঘোষণা দেন মাহমুদউল্লাহ। টেস্ট থেকে ২০২১ সালেই অবসর নেওয়া মাহমুদউল্লাহ এখন পুরো মনোযোগ দিতে চান ওয়ানডে ক্রিকেটে, ‘এই সিরিজের শেষ ম্যাচের পরেই আমি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেব। আসলে এটা আমি এই সফরে আসার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার কোচ, অধিনায়ক, নির্বাচক এবং বোর্ড সভাপতিকেও সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। আমি মনে করি, এটাই সঠিক সময় এই সংস্করণ থেকে সরে গিয়ে সামনে ওয়ানডে যা আছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার। আমার জন্য এবং পরের (টি-টোয়েন্টি) বিশ্বকাপের কথা যদি ভাবি, দলের জন্যও এটাই সঠিক সময়।’

ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে কবে অবসরে যাবেন এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে মাহমুদউল্লাহ বলেন, ‘সময়ই বলে দেবে।’ তবে একটি সূত্র জানা গেছে, তাঁর ইচ্ছা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন ওয়ানডে ক্রিকেট। বাকিটা নির্বাচকদের হাতে।

এই দিল্লিতেই ২০২৯ সালে মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বে ভারতকে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এই সংস্করণে ভারতের বিপক্ষে সেটিই একমাত্র জয় বাংলাদেশের। আজ বিদায়ের ঘোষণাটাও দিলেন সে মাঠেই। স্বাভাবিকভাবেই মাহমুদউল্লাহর মনে পড়ছিল সেই সুখস্মৃতিও, ‘আমাদের জন্য সিরিজের ভালো শুরু ছিল সেটি। আমি আজ যখন মাঠে ঢুকছিলাম, তখনো সেটা মাথায় কাজ করছিল। আমি ওই স্মৃতিগুলো সব সময় মনে রাখব।’

মাহমুদউল্লাহর ছোট সংস্করণের ক্রিকেটকে বিদায় বলার ভাবনাটা জন্ম নেয় মিরপুরে ভারত সফরের প্রস্তুতির সময়। এরপর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ, অধিনায়ক নাজমুল হোসেন ও প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও মাহমুদউল্লাহে সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছেন। তাঁর কথা, ‘আমি ভারত সিরিজের জন্য যখন অনুশীলন করছিলাম, তখনই চিন্তা করছিলাম। পরিবার বলেছিল এটা সঠিক সময় নয়। ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তারপর বুঝেছে। এরপর বোর্ড প্রেসিডেন্ট, কোচ, অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করেছেন।’

সাকিব আল হাসানের মতো ঘরের মাঠে অবসরের সুযোগ ছিল মাহমুদউল্লাহরও। কিন্তু বাংলাদেশ ঘরের মাঠে আবার টি-টোয়েন্টি খেলবে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। মাহমুদউল্লাহ এত দিন অপেক্ষা করতে চাননি, ‘এটা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। আমি যদি বাংলাদেশ থেকে অবসর নিতে চাইতাম, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যেত। আমি মনে হয় ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছি।’ অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, খেলা শুরু করেছিলেন নিজের ইচ্ছায়, শেষটাও করছেন সেভাবেই। ‘আমি খেলা শুরু করেছি আমার টার্মে, বিদায়ও নেব আমার টার্মে’-বলেছেন মাহমুদউল্লাহ।

দীর্ঘ টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ভালো-খারাপ দুই রকম সময়ই গেছে মাহমুদউল্লাহর। এই লম্বা যাত্রায় কোনো আক্ষেপ? মাহমুদউল্লাহ বেশ জোর দিয়েই বললেন, ‘আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলার একটি মুহূর্তও আক্ষেপ করি না।’ একই প্রসঙ্গে পরে আবার বলেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, কোনো আক্ষেপ নেই। এক ফোটাও আক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের হয়ে এত বছর খেলেছি, ব্যক্তিগতভাবে যা আমার জন্য খুবই ভালো ছিল। আমি ২০০৭ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি যতটুকু খেলেছি, জানি না কতটা পেরেছি, তবে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি।’

মাহমুদউল্লাহ সহ পঞ্চপান্ডবেরা বাংলাদেশকে কোনো ট্রফি এনে দিতে পারেননি। এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও মাহমুদউল্লাহর কথা, ‘ট্রফি নেই, এটা অবশ্যই খারাপ লাগার মতো। তবে আমি এ কথাটা মানতে রাজি নই যে আমাদের কোনো অর্জন নেই। যদি ট্রফি জেতাই মানদণ্ড হয়, তাহলে অনেককেই আমরা লিজেন্ড বলতাম না। ২০০৭ সালে যখন আমি এই ড্রেসিংরুমে এসেছিলাম, সেই তুলনায় এখন অনেক পার্থক্য। শুধু পাঁচ পাণ্ডব নয়, এটা সবার অর্জন। আমি তারতম্য করতে পছন্দ করি না।’

টি-টোয়েন্টি ম্যাচ সংখ্যা ও উইকেটের কথা বিবেচনায় এই সংস্করণে বাংলাদেশর অর্জনকেও ছোট করে দেখছেন না এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার, ‘ভালোর তো শেষ নেই। খেলা জিনিসটাই এমন। যত ভালো করেন, আরও ভালো সুযোগ থাকেই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। তবু আমরা যে পরিমাণ ম্যাচ খেলি, ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক, পাশাপাশি যে উইকেটে খেলেছি বাংলাদেশ, সেদিক থেকে খারাপ বলব না।’

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও হতাশাজনক মুহূর্তের কথা জানতে চাইলে মাহমুদউল্লাহ বলেছেন, ‘২০১৬ ব্যাঙ্গালুরু…হতাশাজনক এবং জীবন বদলে ফেরার মতো মুহূর্ত। কারণ আমার জন্য সেটা ছিল অনেক বড় শিক্ষা। আর সেরা মুহূর্ত নিদাহাস ট্রফি।’ নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৩ রানের ইনিংসটিকে বলেছেন নিজের সেরা ইনিংস।